বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০২৫

আদি সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক ব্রাত্যই

শেষ আপডেট:

 

  • কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য

বহুযুগ পরপর পৃথিবীতে কিছু যুগপুরুষ মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছে যাঁরা তাঁদের বর্ণময় সংগ্রামী জীবনচর্যার জন্য রক্তমাংসের মানুষ হয়েও পরবর্তীকালে অতিমানব বা প্রায় ‘মিথ’ হয়ে উঠেছেন-লৌকিক হয়েও তাঁরা অলৌকিক স্বপ্নমানব হয়ে ইতিহাসে বিরাজ করছেন। আমরা উত্তরপুরুষরা তাঁদের রূপকথার চরিত্র ভাবি। দেবেশ রায়ের ভাষায় এঁরা ‘পরণকথার মানুষ’। দলিত ভারতের ক্ষেত্রে আধুনিক সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধো-কানহো (১৮১৫/২০-১৮৫৬), উলগুলান বা মুন্ডা বিদ্রোহের নায়ক বিরসা মুন্ডা (১৮৭৫-১৯০০) এমনকি ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি বিদ্রোহের নায়ক, জঙ্গল সাঁওতালকে (১৯২৫-১৯৮৮) তার উদাহরণ ভাবা যেতে পারে।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বা ব্রিটিশবিরোধী জনজাতীয় কৃষক বিদ্রোহগুলোর ইতিহাসে এর চাইতেও আগুয়ান এক কম চর্চিত কিংবদন্তী চরিত্র আছে। তিনি আদি সাঁওতাল বিদ্রোহের মহানায়ক, তৎকালীন বিহারের ভাগলপুর-সুলতানগঞ্জের তিলকপুর বনাঞ্চলের সাঁওতাল গোষ্ঠীপতি, বাবা তিলকা মাঝি (১৭৫০-১৭৮৫)। আজ থেকে ২৭৫ বছর আগে বিহারের ভাগলপুরে তাঁর জন্ম হয়েছিল। বলা হয়, আগুনের মতো রক্তচক্ষু ছিল বলেই তাঁকে তিলকা নামে ডাকা হত!  তিনি জাবরা পাহাড়িয়া নামেও পরিচিত ছিলেন। তিলকা মাঝির নেতৃত্বেই সিধো-কানহোর আধুনিক সাঁওতাল বিদ্রোহের ৭১ বছর আগে, ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ভাগলপুর-সুলতানগঞ্জে ভারতের প্রথম সশস্ত্র কৃষক অভ্যুত্থান বা আদি সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটেছিল।

সিধো-কানহো বা বিরসা মুন্ডা যদি মহাকাব্যময় ভারতীয় জনজাতি বিদ্রোহের রাম-লক্ষ্মণ বা অর্জুন হন, তাহলে বিপ্লবী তিলকা মাঝিকে আমাদের ভারতীয় জনজাতি বিদ্রোহের বাল্মীকি বলতেই হবে। বাল্মীকি– কারণ তাঁর পদাঙ্ক ধরেই অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর বৃটিশ ভারতে ১৫০ বছর ধরে সংগঠিত হয়েছিল কম করে ২৫টি জনজাতীয় বিদ্রোহ। যদিও এসব বিদ্রোহের সবক’টির পর্যাপ্ত লিখিত ইতিহাস নেই। ১৮৫৫-’৫৬-র সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহ বা ‘উলগুলান’ (১৮৯৯-১৯০০) এগুলোর অন্যতম। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, তিলকা মাঝির নেতৃত্বে সংগঠিত আদি সাঁওতাল বিদ্রোহই ছিল পরবর্তীকালে সংগঠিত ভারতের সকল ব্রিটিশবিরোধী গণসংগ্রামের সুতিকাগার।  তিলকা মাঝিই প্রথম ভারতীয় যিনি সশস্ত্র ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তির-ধনুকের গেরিলা যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। শুধু ভারতবর্ষের নয়, গোটা পৃথিবীর তখনকার পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তিলকা মাঝির এই হাড়হিম করা ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ ইতিহাসবিদদের কাছে আজও একটি বিস্ময় উদ্রেককারী ঘটনা। আরও মনে রাখতে হবে আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছরেরও বেশি আগে ইংরেজদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তিলকা মাঝি যখন বিদ্রোহ করছেন, তখন মঙ্গল পান্ডে, ক্ষুদিরাম তো দূরের কথা, জার্মানির হিটলার, চিনের মাও সে তুং, ভারতের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর– এঁরা কেউই পৃথিবীতে আসেননি। তখনও এমনকি ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবেরও সূচনা হয়নি। ভারতীয় উপমহাদেশে, এমনকি গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধুনিক সভ্যতার আলো ফোটার আগেই অরণ্য-শ্বাপদময় বিহারে, সামাজিক বিপ্লব নয়, রীতিমতো রাজনৈতিক বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়েছিলেন ৩৪ বছরের সাঁওতাল তরুণ তিলকা মাঝি! সিধো, কানহো বা বিরসা মুন্ডার তখন জন্মই হয়নি। অরণ্যবেষ্টিত পল্লিতে পল্লিতে শালপাতার ‘সারজম গিরা’ পাঠিয়ে তিলকা, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সহজ-সরল কুসংস্কারাচ্ছন্ন আদিবাসীদের সংগঠিত করতেন। বলাবাহুল্য মধ্যযুগীয় ভারতে তখন মোগল আমলের শেষ পর্ব। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন সদ্য সদ্য মোগলদের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওডিশার দেওয়ানি পেয়েছে। ওয়ারেন হেস্টিংস তখন সবে বাংলার বড়লাট হয়েছে। তার লক্ষ্য তখন যেনতেনপ্রকারেণ কোম্পানির তহবিল বাড়াও, ভারতীয়দের শোষণ করো!

ভারতীয় মহাফেজখানাগুলোতে রবার্ট ক্লাইভ, কর্নওয়ালিস বা ওয়ারেন হেস্টিংসের আলোকচিত্র থাকলেও ব্রিটিশবিরোধী প্রথম ভারতীয় বিপ্লবী, প্রথম অ্যান্টি–ব্রিটিশ গেরিলা যোদ্ধা, দেশের প্রথম ফাঁসি শহিদ, তিলকা মাঝির ফোটো নেই। আমাদের কাছে যা আছে, তিলকা মাঝি থেকে শুরু করে সিধো-কানহো বা বিরসা মুন্ডা- প্রায় সবগুলোই আঁকা ছবি। তিলকা প্রসঙ্গে যৎসামান্য যা কিছু কথা আছে সেগুলোর অধিকাংশই আবেগতাড়িত আদিবাসী বুদ্ধিজীবী বা কিছু বিহারভিত্তিক মিডিয়ার লোকজনদের লেখা!

মনে রাখতে হবে, ৩০ জুন যে ‘হুল দিবস’ বা, ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস’ পালিত হয় সেই অভ্যুত্থান ঘটেছিল ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বিহারের ভাগনাডিহির মাঠে। জায়গাটি আজকের ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পাহাড়ে। ১৮৫৫-র ৩০ জুন ১০ হাজার সাঁওতাল ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে সিধো-কানহো-চাঁদ-ভৈরব ও তাঁদের দুই বোন এক ঐতিহাসিক ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ, ‘হুল মাহা’ বা ‘সাঁওতাল হুল’ (সাঁওতালি ভাষায় বিদ্রোহকে হুল বলে) সংগঠিত করেছিল। এই বিদ্রোহই ঐতিহাসিক ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত এবং ২০২৫-এ এসে এই অভ্যুত্থান ১৭১ বছরে পড়ল। শুধু এই অভ্যুত্থানই নয় তিলকা মাঝির আদি সাঁওতাল বিদ্রোহের (এই বিদ্রোহকে কেউ কেউ পাহাড়িয়া বিদ্রোহও বলেছে) প্রেরণায় ভারতে কোল বিদ্রোহ, পাইক বিদ্রোহ, উলগুলান বা মুন্ডা বিদ্রোহ, ভিল বিদ্রোহ, ভুমিজ বিদ্রোহ বা গঙ্গানারায়ণী হাঙ্গামা-র মতো বহু জনজাতি বিদ্রোহ হয়েছে।

তিলকা মাঝির নেতৃত্বে আদি সাঁওতাল বিদ্রোহে সাঁওতাল ও পাহাড়িয়া আদিবাসীরা ভাগলপুরের ব্রিটিশ ট্রেজারি লুট করে  অনাহারক্লিষ্ট ও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে সেখানকার ধনভাণ্ডার বিতরণ করেছিলেন। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা তৎকালীন বিহারের রামগড়ের পঞ্জাব রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে ব্রিটিশ সেনাদের সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। আর এই বিদ্রোহের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের এক প্রকাশ্য দিবালোকে তিলকা মাঝি নিজে তাঁর বিষ মাখানো তির দিয়ে ভাগলপুর ও সন্নিহিত এলাকার ব্রিটিশ কালেক্টর ও জজসাহেব, বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের স্নেহভাজন, ৩০ বছরের আগুয়ান স্কটিশ তরুণ, লেফটেন্যান্ট অগাস্টাস ক্লিভল্যান্ড সাহেবকে হত্যা করেছিলেন। ঘোড়ায় চড়ে বনের মধ্য দিয়ে যাবার পথে উঁচু পাহাড়ের গোপন ডেরা থেকে তিলকা তাঁকে তির মেরেছিলেন। পরে জাহাজে করে লন্ডন যাত্রাপথে আক্রান্ত ক্লিভল্যান্ডের মৃত্যু হয়। লজ্জায় ও অপমানে ব্রিটিশরা কলকাতার সাউথ পার্কস্ট্রিটে ক্লিভল্যান্ডের সমাধিফলকে এই করুণ অপমৃত্যুর সঠিক কারণ লেখেননি। বহু চেষ্টার পরে ক্লিভল্যান্ড সাহেবকে বাঁচানো না গেলেও তিলকা মাঝিকে ব্রিটিশ সেনারা তাঁর জঙ্গলের গোপন ডেরা থেকে গ্রেপ্তার করে। বলা হয়, চারটি ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে ভাগলপুরের রাস্তা দিয়ে কয়েক মাইল ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিয়ে গেলে তিলকার দেহ ক্ষতবিক্ষত হলেও তিনি বেঁচে ছিলেন। এমতাবস্থায় ১৭৮৫-র ১৩ জানুয়ারি ভাগলপুরের কালেক্টরের বাংলোর সামনের একটি বটগাছে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। এই ফাঁসিস্থলে এখন তিলকার মূর্তি আছে। তিলকা মাঝির ফাঁসিই ছিল ব্রিটিশ ভারতের প্রথম কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীর ঘোষিত ফাঁসি। এর সঙ্গেই ৩৫ বছরের বীর তিলকা মাঝির জীবনের যবনিকা নামে। তিলকা মাঝির স্মৃতিতে ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নামকরণ হয়, তিলকা মাঝি ভাগলপুর ইউনিভার্সিটি। ভাগলপুর-সুলতানপুরে তিলকার সম্মানে এখন অনেক স্মৃতিচিহ্ন! কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের লিখিত ইতিহাসে তিলকা মাঝি আজও কম উচ্চারিত, প্রায় ব্রাত্যই!

 (লেখক লোকগবেষক সাহিত্যিক শিলিগুড়ির বাসিন্দা)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

কানকাটা ভ্যানগগ ও শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউট

শেখর বসু ফুলারটন হলের আচ্ছন্নতা কাটতে একটু দেরি হয়েছিল। আস্তে...

পর্যটন ছাড়াও উত্তরবঙ্গের ভাঁড়ার সমৃদ্ধ

তিতীর্ষা জোয়ারদার গরম বা শীতের ছুটি মানেই, ভ্রমণের হাতছানি।...

নিজস্ব ছটায় শেষ দিন পর্যন্ত স্বতন্ত্র

  আশিস ঘোষ কমরেড স্তালিন কি হাসেন? সোভিয়েত জমানায়...

মিষ্টি হোক বা তেতো দিনটা চকোলেটের 

অরিন্দম ঘোষ আমাদের ছোটবেলায় বয়স্ক মানুষরা কেউ কেউ গাল টিপে...