সুস্মিতা গঙ্গোপাধ্যায়, গুয়াহাটি: অনুশীলন, পালটা গোয়েন্দাগিরি থেকে চোট-আঘাত, দলের পরিস্থিতি, ম্যাচ-ভেনু নিয়ে লুকোচুরি ও চাপানউতোর। কর্পোরেট কোচ-ফুটবলার-কর্তারা যে কীভাবে সেই সত্তরের দশকের বড় ম্যাচের মানসিকতা ও আবহে ফিরে গেলেন, বোঝা দায়!
পৌষ সংক্রান্তির জন্য শীত আবার জাঁকিয়ে বসার ইঙ্গিত দিলেও ডার্বি ঘিরে হঠাৎই উত্তাপ, শহর কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ হয়ে সটান গুয়াহাটি পর্যন্ত। ডুরান্ড কাপ, সুপার কাপ কী বিলুপ্তপ্রায় রোভার্স কাপ বা ফেডারেশন কাপের মতো আরও কিছু টুর্নামেন্টে কলকাতার বাইরে একে অপরের মুখোমুখি লড়াইয়ে নামার মতো উদাহরণ অজস্র আছে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ লিগে মোহনবাগান সুপার জায়েন্ট-ইস্টবেঙ্গল, একে অপরের বিপক্ষে একমাত্র করোনার সময় দুই বছর ছাড়া আর হয়নি। আই লিগের সময়ে এরকম পরিস্থিতিতে দিন-তারিখ বদলে যেত কিন্তু ভেনু বদলের কোনও উদাহরণ মনে করা যাচ্ছে না। আর আইএসএলে প্রথম দুই মরশুম কোভিডের জন্য সব দলকেই একটাই জায়গায় খেলতে হয়েছে। ফলে ওটাকে ব্যতিক্রমীই ধরা উচিত। বরং ‘আইএসএলের প্রচুর টাকা, ওরা যা ইচ্ছা তাই পারের মতো ভাবনা থেকে হঠাৎই বাস্তবের মাটিতে ধপাস করে পড়ে লিগের সবথেকে গ্ল্যামারাস লিগের দখল পেয়ে গেল গুয়াহাটির মতো একটা শহর। সৌজন্যে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট ও রাজ্য সরকার। অসম-প্রশাসনও কম যায় না। কয়েকদিন ধরে খেলিয়ে শেষপর্যন্ত দিন দুয়েক আগে অনুমোদন দেওয়াতেই সেটা পরিষ্কার।
এসব নিয়ে কোচদের বসে থাকলে তো চলে না। ১১ তারিখ ম্যাচটা খেলতেই হবে, এই বার্তায় অন্তত দিন দশেক আগে ডামাডোল পরিস্থিতি তৈরি হওয়া মাত্রই তাঁদের দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে হোসে ফ্রান্সিসকো মোলিনাই হোন কী অস্কার ব্রুজোঁ, দুই স্প্যানিশই নিজের নিজের লড়াইয়ের অস্ত্রে শান দিয়েছেন। অস্ত্রের ধার কার কেমন হল, সেই পরীক্ষায় নামার আগেই অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে ইস্টবেঙ্গলের ঔজ্জ্বল্য খানিক কমই লাগছে। এমনিতেই আইএসএলে হেড টু হেডের তুলনা টানলে কিঞ্চিত লজ্জিতই হতে হয় লাল-হলুদ সমর্থকদের। প্রায় প্রতি ম্যাচের আগেই যা কোচেরা বলেন ব্রুজোঁর মুখেও সেই কথাই, ‘আমার কোচিং জীবনের অন্যতম কঠিন ম্যাচ। শনিবার ওদের থামাতে যা যা করা দরকার, সবই করব এবং আশা করি, ম্যাচের পর সমর্থকদের মুখে হাসি ফুটবে।’ মুখে এই বিনা যুদ্ধে সুচগ্র্যমেদিনী না ছাড়ার কথা বললেও তিনিও জানেন, তাঁর ঢালতরোয়ালের জোর বড়ই কম। দলে একাধিক চোট তাঁকে আরও বেশি করে সমস্যায় ফেলেছে। সাউল ক্রেসপো-মাদি তালাল, মহম্মদ রাকিপরা তো নেই। এমনকি এদিনের অনুশীলনে হঠাৎই অনুপস্থিত আনোয়ার আলির মতো গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার, সঙ্গে প্রভাত লাকড়াও। কোচ গম্ভীরমুখে জানালেন, ‘আনোয়ার-প্রভাত লাকড়া দলের সঙ্গে যাচ্ছে না।’ তাঁর বক্তব্য নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা তৈরি হল এতে। কতটা সত্যি বললেন আর কতটা প্রতিপক্ষকে ধাঁধায় রাখতে কথায় জল মেশালেন পরিষ্কার নয়। তবে যদি সত্যি হয় তাহলে ডিফেন্সের সঙ্গে মাঝমাঠ নিয়েও চাপ বাড়ল। সে মাঝমাঠে যতই সৌভিক চক্রবর্তী ফিট হয়ে ফিরুন না কেন। মোহনবাগান সুপার জায়েন্টের যতই অনিরুদ্ধ থাপা না থাকুন, হোসে ফ্রান্সিসকো মোলিনার দলের ভয়ংকর অ্যাটাক লাইনকে আনোয়ারবিহীন হেক্টর ইউস্তে-হিজাজি মাহের জুটি কীভাবে সামলান সেকথা ভেবেই মাথার চুল ছিঁড়তে পারেন সমর্থকরা। সামনে অবশ্য এই ম্যাচে শুরু থেকে ডেভিড লালহালানসাঙ্গাকে নামিয়ে একটা ফাটকা খেলতে পারেন তিনি। মোলিনা আবার আগেই বলে নিলেন, ‘ওদের অনুশীলনে কোনও গুপ্তচর লাগাইনি কারণ প্রতিপক্ষকে নয়, আমার ভাবনায় থাকে আমার দল।’ এরপর বিশ্লেষণে যান, ‘লিগের কোন পজিশনে দলটা আছে সেটা বড় কথা নয়। ডার্বি সবসময়ই ডার্বি। এর গুরুত্বই আলাদা। তাছাড়া আগের ডার্বিতে অস্কার তখন সবে এসেছে। তারপর চার মাস কেটে গেছে। ইস্টবেঙ্গল এখন ওর পরিকল্পনামাফিক খেলার জন্য তৈরি বলেই আমার মত। তবে প্রতিপক্ষের লড়াইয়ের জবাব আশা করি আমার ছেলেরা দিতে পারবে।’
তাঁর প্রথম একাদশে পরিবর্তন হলে একমাত্র জেসন কামিংসের জায়গায় গ্রেগ স্টুয়ার্ট শুরু করতে পারেন। চোট পাওয়া থাপার জায়গায় সাহাল আব্দুল সামাদ ও দীপক টাংরি আছেন খেলার জন্য। কিন্তু কে খেলবেন বা দুজনেই খেলবেন কিনা, সেটা অবশ্যই নির্ভর করছে সামনে জেমি ম্যাকলারেনের সঙ্গে কে, তার উপর। দিমিত্রিস পেত্রাতোস পরেই নামবেন, এটা নিশ্চিত। ইস্টবেঙ্গলের কাছে এখন চ্যালেঞ্জ মোহনবাগানের শেষদিকে তরতাজা স্টুয়ার্ট-দিমিদের মতো মানের ফুটবলারকে আটকানো। সেটা পারলে গুয়াহাটির মতো বাঙাল অধ্যুষিত অঞ্চলে মশাল জ্বলতে পারে শনি-রাতে। নাহলে ব্রহ্মপুত্রেও সেই পালতোলা নৌকোই চলবে।