উত্তর সম্পাদকীয়

ক্লান্তিহীন সংগ্রাম আর ধূপের গন্ধ

  • মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস

ছোট ছোট ঈর্ষার আকাশকে খোলা নীল উন্মুক্ত উদার করে তোলা কালে কালে নারীদের বর্তায়। ‘মা ভালো তো ছা ভালো’ একথা যে কতবার কানে ঢুকে মগজে আর মর্মে ঝড় তুলেছে! শ্রমজীবী নারী থেকে অট্টালিকার বিলাসী নারীরও তটস্থ থাকার গল্প জানি। সন্তান জন্মের দায় যেমন তার মায়ের (ছেলে না মেয়ে), রূপ রংয়ের তারতম্য যেন মা’র দায়। ‘রুনু তোর মেয়েটা তোর রং পায় নাই …’ কথাটুকুতে মা’র মুখে নিভে যাওয়া আলো দেখেছি, যা মাটির উনুনের গলগলে ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে অঙ্গারে লাল হয়েছে।

এই বিশেষ দিনেই কেন মনে হয় এসব কথা! ওই একটি দিন অন্তত হোক মায়েদের আপামর মহিলার সম্মানের দিন। ক্লারা জেটকিনের দাবিতে আজ শুধুই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী মর্যাদার দিন নয়, নারীর সম্মানে অন্তত একদিন মানুষ পুরুষতন্ত্র ভুলে সম্মানের পতাকা তুলুক হাতে। যার রং হোক বেগুনি, সবুজ, সাদা। নারী দিবসের রং। ন্যায় ও মর্যাদা, আশা আর শুদ্ধতার রং।

গণসচেতনতা এভাবেই হোক মুখর। ছোট ছোট স্বার্থ, ঈর্ষা নারীর পরস্পর সম্পর্কও দূরে ঠেলেছে। এযাবৎ শ্বশ্রূমাতা যা ভোগ করেছেন তা বর্তেছে পুত্রবধূতে। মেয়েরা শিশুকাল থেকে শেখে সংসার বেঁধে রাখার দায় নারীর। ওই ‘রমণীর গুণ’ শব্দটা বদলে গিয়েছে। এখন যাপন অন্য কথা বলে।

মফসসল শহর কোচবিহারে ফিরে যাওয়া মেয়ে পঞ্চাশ বছরে পৌঁছে যদি শোনে তার মা যখন মাত্র সতেরোর তরুণী, ব্রাহ্মণ পরিবার ছেড়ে কায়স্থ পরিবারে আসায় জনসমক্ষে রাস্তার ওপর সতেরোর কুশপুত্তলিকা জ্বলেছিল আক্ষরিক অর্থেই। জ্বালিয়েছিলেন মেয়েটির দাদামশাই। তাঁর কাছে কন্যা মৃত এই ঘোষণায়, তখন সেই মা’র কন্যা মার অপমানে ফুঁসেছে কেবল। সময় চলে গিয়েছে। দাদামশাইয়ের নির্ভরতা দেখেছে ওই পরিত্যাজ্য মেয়ের ওপরই সারাজীবন। বুকের ভিতর তখনকার মায়ের অপমান কুশের আগুনের মতোই পুড়িয়েছে, এখনও পোড়ায়। ওই ব্রাহ্মণত্ব কবেই ধুলোয় মিশেছে!

এইসব টুকরো অপমানের ওপর তিস্তা বা তোর্ষা জলকল্লোল কতই ঢেউ এনেছে, স্রোতের বদল ঘটেছে। অত্যাচার মুক্ত অনাবিল নারী সম্মানের স্বাধীনতা এসেছে। জলকল্লোলে এসে দাঁড়িয়েছে দেবী চৌধুরানির বজরা। হাত বাড়িয়েছে।

চা বাগানে কর্মী মায়েদের জ্যোৎস্নার গান শোনা গিয়েছে। জলপাইগুড়ির মাটির গন্ধে, মাটিকেই  ভালোবেসে প্রকৃতি যেমন কল্যাণময় হয়েছে, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজে আর গন্ধে উঠে এসেছেন বীর কন্যারা। ভারতের মূল আন্দোলনে প্রতিবাদে উপজাতি নারীরা জড়িয়ে গিয়েছেন কতবার। গ্রেপ্তার হয়েছেন সোমা ভগত, বিখানী দাস, দেবীগঞ্জ এলাকার পূর্ণেশ্বরী বর্মন, সে বুড়িমা নামেই খ্যাত। পহাচপীরের উজানী বর্মন, ডেঙ্গুয়াঝাড়ের মাইলি মাঝি এঁরাও এগিয়ে আসেন দলে দলে। তেভাগা আন্দোলনে সক্রিয় যোগদান দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। নারী শিক্ষা প্রসারে ১৯২৫ সাল থেকে চেষ্টা করেছেন, ১৯৫৪ সালে সরাসরি শিক্ষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন সুনীতি বালা চন্দ। জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন করেছেন সেইসঙ্গে কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। পরে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত  হন।

… ‘স্বাধীনতা, তোমার জন্যে হাঁটতে পারি হাজার বছর

ভাঙতে পারি হাতের শাঁখা আগুন করে তুলতে পারি সিঁদুর টিপ…’

পড়ছিলাম ওঁদের কথা। অপরিসীম সাহস, অনাবিল উদ্যম, একনিষ্ঠ দেশপ্রেম আর মাটির টানে মহিলারা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন নিষেধের পর্দা। সকলের কণ্ঠে ১৯৩০-এ গর্জন ‘ইংরেজ আইন মানব না-মানি না।’

প্রতিমা বিসর্জনের নৌকোয় প্রতিমা নেই। প্রচার হচ্ছে ‘স্বাধীনতা আমাদের জন্মগত অধিকার।’ অসীম সাহসী এক নারী ‘অরুণা দাশগুপ্ত’। সেসময় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। দেশের জন্য বিহ্বল ডুয়ার্সের মহিলাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হন হীরা প্রভা সেন, ননীবালা ভৌমিক, সুনীতি নিয়োগী, সুকুমারী সেন। প্রতিবাদী হন মহেন্দ্র বালা দেবী, বীণা চৌধুরী, সরযূ সরকার, রানি ভৌমিক ইত্যাদি। নেতৃত্ব দেন সুভাষিণী ঘোষ। তিনি কংগ্রেস নেতা যোগেশচন্দ্র ঘোষের স্ত্রী ও মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী ছিলেন বহুদিন। যুব সম্প্রদায়কে তিনি পথ দেখিয়েছিলেন।

মহিলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পরিচালনা করেছিলেন সুনীতি নিয়োগী। কৃষক আন্দোলনে মহিলা কর্মী বিভা দত্ত, কল্যাণী চন্দ, কল্পনা নিয়োগী, লীলা সেন, আশা রায় চৌধুরী, অমিয়া নন্দী… এঁরা প্রচারের কাজে ছিলেন। ১৯৪২, ভারতজুড়ে ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। বহু বিপ্লবীর সঙ্গে ছিলেন বাসন্তী রায়, সন্ধ্যা কর, কল্যাণী দাশগুপ্ত আরও অনেক বীরাঙ্গনা। গ্রেপ্তার হন।

৯ অগাস্ট বিরাট মিছিল। সামনের সারিতে পতাকা নিয়ে তারা ব্যানার্জি ও উমা দাশগুপ্ত। এছাড়া অরুণা সান্যাল, রেবা সান্যাল, দীপ্তি রায়, গীতা গুহ, মিলু দত্ত, প্রতিভা চক্রবর্তী ইত্যাদিরা পথে নেমেছিলেন। ১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৩, ১৪৪ ধারা অমান্য করে বিরাট মিছিল বের হয় জলপাইগুড়িতে। সত্যেন্দ্রনাথ সেনের মেয়ে সুকুমারী সেন গ্রেপ্তার হন।

একঝাঁক হংসবলাকার মধ্যে লেখাপড়া না জানা গ্রাম্য আদিবাসী এক কন্যা বিগু উড়াওনি। মাতৃভাষা উড়াঁওতে কথা বলতেন। হিন্দি বাংলায় বুঝিয়ে দিতেন সকলকে আর মানুষ ভালোবাসতেন। এই যে কুসংস্কার সরিয়ে ‘এগিয়ে যাওয়ার, সৃষ্টি কর, গড়ে তোল’ পরিবেশ, ওই বিগু ওরাওঁয়ের মতো কত নারী সম্মান রক্ষায় পথে নেমেছিলেন সেদিন।

স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি রাজনগরের নারীদের। সামনে ছিল কুসংস্কার মুক্ত উদার শিক্ষিত এগিয়ে চলা এক নারী মহারানি সুনীতি দেবী। সবচেয়ে বড় কথা মহারাজা ও রাজবাড়ির বিপুল কর্মধারা ও প্রশ্রয়ে নারীরা করেছেন ‘আনন্দমেলা’। নিজেদের হাতে তৈরি খাবার শুধু নয়, হাতের কাজ দিয়ে মেলা সাজানো হয়েছে মেয়েদের ও অন্যদের জন্য। পর্দাপ্রথা ছিল, উঠেও গিয়েছিল কর্মস্রোতে। প্রথমদিকে স্কুলে (নাম তখন সুনীতি কলেজ) ইংরেজ গভর্নেস শিক্ষা দিয়েছেন। ঠাকুমা বলতেন ‘মেম দিদিমণি’। সংস্কৃতির বিনিময় চলেছে তখন।

নরনারায়ণ মহিষী ভানুমতী থেকে বৃন্দেশ্বরী, সুনীতি দেবী, তাঁর পুত্রবধূ নিরূপমা দেবী কিংবা রাজকুমারী গায়ত্রী দেবীর যে শিক্ষা সংস্কৃতির প্রতিফলন শহরের বিভিন্ন পরিবার, বিভিন্ন নারীর সংস্কৃতি ধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিফলিত। প্রথম বিএ ইন্দিরা রায়ের নাম সকলে জানেন। আর একজন নারী অরুণা দেবী। ১২ জন সন্তানের জননী হয়েও ১৯৬৩ সালে বিএ পাশ করেন। সংসারের বন্ধন তাঁকে বাঁধতে পারেনি। খাদ্য আন্দোলনে প্রাণ দেওয়া বকুল, বন্দনা, কবিতার নাম সকলের জানা। কবি শঙ্খ ঘোষের কলমও যাঁদের রক্তে সোচ্চার ছন্দে দুলে উঠেছিল। সংস্কৃতি, সাহিত্য, সংগীত, নাটক, চিত্রশিল্পে, বিভিন্ন আন্দোলনে, রাজনীতির অঙ্গনে রাজনগরের নারী মুখ আলোর মতো।

বালুরঘাটের একজন মানুষ গড়ার কারিগরের নাম শোভা মজুমদার। বালুরঘাট গার্লস স্কুলের প্রধান ছিলেন ষাট, সত্তরের দশকে। ছাত্রীদের দৃঢ়তা ও শিক্ষার পথপ্রদর্শক শুধু নন, মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন, ভালোবাসা বুকে নিয়ে কাজ করেছেন। এমনই একজন প্রধান শিক্ষিকা নারায়ণী অধিকারী। সেসময় রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। নারীর জন্য উদার আকাশ এঁরাই দেখিয়েছিলেন।

আসলে নারীর আকাশ ছায়াচ্ছন্ন রাখলে, অধিকাংশই আলাদা উল্লাস পোষণ করে এসেছে গোপনে বা প্রকাশ্যে। এখনও সে চেষ্টা আছে বিভিন্ন পর্বে। নারীর কোনও সাহায্যকারী থাকে না প্রকৃত অর্থে। কৌশলে পিছিয়ে দেওয়ার প্রবণতা সর্বত্র। নারী প্রগতির পুরোধা লেখকদের নাম বুকের ভিতর আগুন হয়ে জ্বলে। আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, রাধারানি দেবী, নবনীতা দেবসেন… শ্রদ্ধা জ্বেলে রাখি।

মুষ্টিমেয় ক’জন মানুষ নারী কথায় উদারতা মিশিয়ে পথে নামি! নারীকেই বলি, সমব্যথী হও। আর কোনও নিরুপমা না, মৃণালের ঘরছাড়া নয়, কাজের মধ্যেই গড়ে উঠুক প্রতিবাদ। শুধু সন্দেশখালির মেয়েরাই নয়, যারা বলতে পারেনি কথা, বলুক। সবাই নিজেকে চিনুক। সফল হোক নারীত্বের জয়যাত্রা।

(লেখক সাহিত্যিক। জলপাইগুড়ির বাসিন্দা)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Sex Worker | ঘরের বৌকে যৌনকর্মী হতে চাপ! কাঠগড়ায় স্বামী-শাশুড়ি

শিলিগুড়ি: সন্তান জন্মের পর থেকেই বাড়ির বৌকে যৌন ব্যবসায় নামানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন খোদ স্বামী…

9 hours ago

Siliguri | গৃহবধূকে দুই মেয়ে সহ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ শাশুড়ির বিরুদ্ধে

শিলিগুড়ি: স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই গৃহবধূকে অত্যাচারের অভিযোগ শাশুড়ি ও ননদের বিরুদ্ধে। দুই কন্যা সন্তান…

11 hours ago

Manikchak | তৃণমূল অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ, কাঠগড়ায় কংগ্রেস

মানিকচক: তৃণমূল (TMC) অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠল কংগ্রেসের (Congress) বিরুদ্ধে। মালদার মানিকচকের…

11 hours ago

Mamata Banerjee | সিপিএমের সঙ্গে নন্দীগ্রামে গণহত্যা ঘটিয়েছিলেন শুভেন্দু-শিশির! নাম না করেই বিস্ফোরক ইঙ্গিত মমতার

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক : নন্দীগ্রাম গণহত্যা নিয়ে ফের বিস্ফোরক মমতা। এবার নাম না করে…

12 hours ago

Malda news | নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

মালদা: নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীর যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করল মালদা জেলা আদালত। এছাড়া…

12 hours ago

Abhijit Ganguli | মমতাকে নিয়ে ফের ‘কুকথা’ অভিজিতের! তৃণমূলের অভিযোগে শোরগোল

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বিচারপতির চেয়ার ছেড়ে জনতার দরবারে হাজির হয়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Abhijit Ganguli)।…

12 hours ago

This website uses cookies.