- জয়ন্ত ঘোষাল
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল আপাতত হাজতবাস করছেন। কেজরিওয়ালই যে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি শ্রীঘরে ঢুকেছেন এমন কিন্তু নয়। ভারতের বহু মুখ্যমন্ত্রী বারবার জেলে গিয়েছেন। সে লম্বা তালিকার মিছিলে লালুপ্রসাদ যাদব থেকে জয়ললিতা, চন্দ্রবাবু নাইডু, ওমপ্রকাশ চৌতালা, ঝাড়খণ্ডের মধু কোড়া, জগন্নাথ মিশ্র, হালে হেমন্ত সোরেনও আছেন। হেমন্তর বাবা শিবু সোরেনও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং জেলে গিয়েছেন। তবে, যেদিন জেলে যাচ্ছেন সেইদিন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কি না সেটাও একটা গবেষণার বিষয়। কেজরিওয়াল সম্ভবত সক্রিয় মুখ্যমন্ত্রী যিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই হাজির হয়েছিলেন আদালতের সমনের ভিত্তিতে। সমনে হাজির হতে গিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার বরণ করতে হয়েছে।
কেজরিওয়ালের জীবনেও কিন্তু এটা প্রথম হাজতবাস নয়। তবে তার প্রেক্ষাপট ছিল আলাদা। ২০১১ সালে তাঁর গুরু আন্না হাজারের সঙ্গে আইন অমান্য করতে গিয়ে সাতদিনের জন্য জেল খেটেছিলেন কেজরিওয়াল। সেই সময়ে ২জি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ডিএমকে নেতা এ রাজার সঙ্গে হাজতবাস করার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। কিন্তু ঠিক তেরো বছর আগে লোকপালের দাবিতে অনশনরত আন্না হাজারের পাশে বসে তরুণ অরবিন্দ কেজরিওয়াল কী বলেছিলেন আমাদের সকলেরই মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘এমনটা যেন না হয় যে আমাদের মধ্যেই কেউ ক্ষমতায় এল, আর দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ল। তাহলে তো আজকের এই লড়াইয়ের যে মূল আদর্শ সেটা থেকেই আমরা বিচ্যুত হব।’
সত্যি সত্যি কি কেজরিওয়াল সেই সমাজ আন্দোলনের মতাদর্শ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন? আম আদমি পার্টির রাজনৈতিক উত্থান হল। মুখ্যমন্ত্রী হলেন সবাইকে চমকে দিয়ে। বিজেপি ভাবতেও পারেনি। কেননা ২০১১ সালে যখন রাজনীতির ময়দানে তিনি পা রেখেছিলেন, সেই কেজরিওয়াল তো নিতান্তই বহিরাগত ছিলেন। খড়্গপুর আইআইটি কলেজ থেকে পাশ করা একজন ইঞ্জিনিয়ার। তারপর তিনি হলেন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। পাশ করলেন রেভেনিউ সার্ভিসের পরীক্ষায়। ২০১৩ সালে তিনি প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হলেন স্বল্পমেয়াদে। তারপর ২০১৪ সালে তিনি মোদিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বারাণসীতে প্রার্থী হয়ে পরাস্ত হলেন বটে, কিন্তু ২০১৫ সালে মোদির সামনে থেকে দিল্লির সত্তরটা বিধানসভা আসনে ৬৭ আসন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন এই কেজরিওয়াল।
কেজরিওয়াল তো সেদিন একথা বলেছিলেন যে, বিজেপির সব থেকে বড় শত্রু হল এই মুহূর্তে আপ। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি মুক্ত ভারত গঠন করার ক্ষমতা কেজরিওয়ালই রাখেন। অর্থাৎ কিছুদিন আগে বলা এই কথাটা এটা কেজরিওয়ালের দীর্ঘমেয়াদি রণকল্পনার অঙ্গ। কিন্তু হাজতবাস করতে করতে মুখ্যমন্ত্রিত্ব– এটা কিন্তু এক সম্পূর্ণ অভিনব বিষয়। এভাবে সরকার চালনা লালুপ্রসাদ যাদবও করতে পারেননি। লালুর স্ত্রী রাবড়িদেবী অনভিজ্ঞ। তবুও তিনি রাজ্যপাট চালাতে চালাতে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন। কেজরিওয়ালের ক্ষেত্রে কিন্তু আপাতত আদালত বলেছে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালাতে পারেন।
এই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করছে এনফোর্সমেন্ট, আয়কর বিভাগ। কিন্তু শেষপর্যন্ত কী হবে জানা নেই। তবে আপাতত আদালতের নির্দেশে মুখ্যসচিব এবং সরকারি অফিসারদের যেতে হচ্ছে জেলে। বিভিন্ন মন্ত্রীরাও দেখা করছেন, সরকারের পরামর্শ নিচ্ছেন। আম আদমি পার্টির নির্বাচনি ইস্তাহার ঘোষণা হয়েছে। সেখানে যেসমস্ত স্বপ্ন কেজরিওয়াল দেখিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়িত করার জন্য সব রকমের সরকারি কাজ ভোটের সময়ও চলছে।
এইভাবে সরকার পরিচালনার দৃষ্টান্ত ভারতের রাজনীতি কেন গোটা পৃথিবীর রাজনীতিতে অনেক কম আছে। ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে গ্রেপ্তার করা যায় না। সেখানে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ আছে। রাজ্যপালদের ক্ষেত্রেও আছে একইভাবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে নেই। নেই বলেই নরসীমা রাওকেও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পুলিশ টেকনিকালি তাঁর মতিলাল নেহরু মার্গের বাড়িতে গিয়ে গ্রেপ্তার করেছিল। প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় গিয়েছিলেন জামিনের জন্যে মধ্যরাতে। সেইভাবে মুখ্যমন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করা যায়। এবং সেটা বারবার ভারতীয় রাজনীতিতে হয়েছে।
কিন্তু কেজরিওয়াল সত্যি সত্যি কি পারবেন এইভাবে রাজ্যপাট চালাতে? অনেকে বলছেন পারবেন। তার কারণ কেজরিওয়াল নিজে কিন্তু কখনও কোনও দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন না। তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকলেও তাঁর কোনও সইতে, কোনও দপ্তর চলত না। মুখ্যমন্ত্রীর শলাপরামর্শ নেওয়া হত, কিন্তু তাঁর কোনও সই কোথাও ছিল না। সেই কারণে কেজরিওয়ালকে শেষপর্যন্ত কতটা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা সম্ভব হবে শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে তো প্রমাণ করা যায় না? প্রমাণ করতে গেলে কাগজপত্র সাক্ষিসাবুদ প্রয়োজন হয়। সেই কারণেই সম্ভবত কেজরির পরে অন্য মন্ত্রী এবং রাজ্যসভার সাংসদেরও ইনকাম ট্যাক্স এবং এনফোর্সমেন্ট সক্রিয় হয়ে তাঁদের পেছনে লেগেছে।
যেমন রাঘব চাড্ডা, সঞ্জয় সিং, সৌরভ ভরদ্বাজ, অতিশী মারলেনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই কারণেই এখন কেজরিওয়ালের পাশাপাশি এঁদের বিরুদ্ধেও জোরদার তদন্ত শুরু হয়েছে। রাঘব চাড্ডাকে নিয়ে স্ত্রী পরিণীতি চোপড়া গিয়েছিলেন লন্ডনে। রাঘবকে রেখে পরিণীতি ফিরে এসেছেন। বিজেপির মুখপাত্র অমিত মালব্য এক্স হ্যান্ডেলে মন্তব্য করতে ছাড়েননি, রাঘব চাড্ডা কি গ্রেপ্তারের ভয়ে পলাতক? এইভাবে নির্বাচনি রাজনীতি সরগরম।
কেজরি কিন্তু নির্লিপ্ত। কেজরিওয়াল বৌদ্ধ রীতি অনুসারে ‘বিপাসনা’ অনুষ্ঠানে যান। কখনো-কখনো দশদিন, কখনও পনেরো দিন মোবাইল ছাড়া একটা ঘরে একা থাকেন। ধ্যান করেন। সেইভাবে তিনি যে নিজের আত্মসংযম তৈরি করেছেন সেটা বোধহয় এখন এই হাজতবাসে কাজে লাগছে। তিনি তাঁর স্ত্রী সুনীতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। সুনীতা কিন্তু কেজরিওয়ালের সুযোগ্য সহধর্মিণী হিসেবে নয়াদিল্লিতে রামলীলা ময়দানে পর্যন্ত হাজির হয়ে ‘ইন্ডিয়া গোষ্ঠী’-তে শামিল হয়ে জোরদার বক্তৃতা দিয়েছেন। অনেকে বলছেন যদি কোনও কারণে কেজরিকে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরে যেতেও হয়, সুনীতাকে এগিয়ে দেওয়া হতে পারে। আর যদি কেজরিওয়াল থাকতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে, তাহলেও তাঁর স্ত্রী প্রশাসনের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়সাধনের জন্যে দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁর স্ত্রী এটাও বলেছেন, কেজরি জেলে আছেন বলে সাধারণ মানুষের সমস্যা তিনি হতে দেবেন না। জলের সংকট, বিদ্যুতের সংকট, গরম আসছে। এই পরিস্থিতিতে ভোটের সময় সাধারণ মানুষের ওপর যাতে কোনও দুর্যোগ নেমে না আসে, তা দেখবেন।
এই সমস্ত প্রচার কি বিরোধীদের বিরুদ্ধে যেতে পারে? কেউ কেউ বলছেন, বিজেপি যেটা করেছে, এনফোর্সমেন্ট, সিবিআই, সবশেষে আয়কর বিভাগ যেটা করেছে, সেটা একটু বাড়াবাড়ি। এতটা বোধহয় প্রয়োজন ছিল না। এটাতে হিতে বিপরীত না হয় বিজেপির জন্য। কেননা কেজরিওয়াল একটা ভিকটিম স্ট্যাটাস পাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি ক’টা ফাইল সই করলেন সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু রাজনীতিতে এটা যেন আবার কেজরির জন্য একটা লাভের কারণ না হয়ে যায়।
সবশেষে একটাই কথা বলার। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে একটা রাজ্য চালাতে গেলে কিন্তু কেজরিওয়ালকে সাতটা লোকসভা কেন্দ্রে এই মুহূর্তে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজন নেই। তিনি জেলে বসে ভিডিও কনফারেন্সিং করার অধিকার পেয়েছেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রতিদিন আমলাদের সঙ্গে কথা বলছেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, পরামর্শ নিচ্ছেন এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারছেন। মোবাইল ফোন ব্যবহার এবং ভিডিও কনফারেন্স, দুটো যদি করতে পারেন, ফাইল চেয়ে পাঠাতে পারেন, মতামত দিতে পারেন, তাতে রাজ্যপাট চালানো জেল থেকে অসম্ভব নাও হতে পারে।
(লেখক সাংবাদিক)