Thursday, February 13, 2025
Homeসম্পাদকীয়উত্তর সম্পাদকীয়নবির ছোঁয়ালাগা চাঁদ ও সেই চাঁদে মানুষ

নবির ছোঁয়ালাগা চাঁদ ও সেই চাঁদে মানুষ

চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে মানুষের মনে সহজে ওঠে না। মানুষ যখন চাঁদে গিয়ে পৌঁছোল, সেদিন যন্ত্রের সেই শক্তিকে গ্রামের লোক সাংঘাতিক অবিশ্বাস করেছিল। জনে জনে সেদিন বলতে শুনেছি, মানুষ চাঁদে গিয়েছে, এটা এক মস্ত ফাঁকির কথা। এ এক বিজ্ঞানওয়ালাদের রটনা।

  • আবুল বাশার

মানুষ সব পারে, তার অসাধ্য কিছু নেই। সুখের কথা, একথা অমান্য করার মতো মানুষের সংখ্যা এদেশে ক্রমশ কমছে। মানুষ ধর্মের কলকে বিশ্বাস করে, কারণ তা বাতাসে নড়ে, কিন্তু তার নিজের তৈরি কল নড়ে বাষ্পে বা বিদ্যুতে, একথা চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে সেই মানুষের মনে সহজে ওঠে না। মানুষ যখন চাঁদে গিয়ে পৌঁছোল, সেদিন যন্ত্রের সেই শক্তিকে গ্রামের লোক সাংঘাতিক অবিশ্বাস করেছিল। জনে জনে সেদিন বলতে শুনেছি, মানুষ চাঁদে গিয়েছে, এটা এক মস্ত ফাঁকির কথা। এ এক বিজ্ঞানওয়ালাদের রটনা। মানুষের এত বড়াই ভালো নয়।

গ্রামের এক বৃদ্ধ আমাকে ঈষৎ ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, আমার ধর্মের নবী সাত তবক (স্তবক) আশমান পার হয়ে খোদার কাছে দিদার করতে গিয়েছিলেন, মিরাজ তার নাম, কই তেনার তো ফুটনিক লাগেনি। চাঁদ তো পয়লা-আশমানেই আছে, নবির ইশারায় ওই চাঁদ দু’ভাগ হয়েছিল, সেই ছাপ, ফাটা দাগ তোমার বিজ্ঞানীরা দেখেছে? নবির ছোঁয়ালাগা ওই চাঁদ, ওই চাঁদ দেখে আমরা রোজ নমাজ পালাপার্বণ করি, মানুষ সেখানে চলে গেল? এসব হল গালগল্প, বুঝলে! বিজ্ঞান হল তামাশার জিনিস, নানা রকম কেরামতি করছে, নিজের দোষেই ধ্বংস হবে। খোদার উপর খোদকারি করার মাশুল দিতে হবে।

আমি এক অস্তরাগের মুহূর্তে মেঘভাঙা রাঙা আকাশে কালো কুচকুচে একটি নিঃশব্দ জেট বিমান দেখেছিলাম, সেই প্রথম এক খেলার মাঠে বসে, সে এক অভূতপূর্ব বিস্ময়মাখা দৃশ্য। সাদা ধোঁয়া ছেড়ে ছেড়ে আকাশ বিহার করে ডুবুডুবু সূর্যের কাছে চলে যাচ্ছে একটি কালো চিল যেন বা! আমরা যারা সেদিন ফুটবল খেলা থামিয়ে সন্ধ্যার মুখে দৃশ্যটি দেখে অভিভূত হয়েছিলাম, সেদিন খেলাও ভেঙে গিয়েছিল, তারপর ভাসমান ধোঁয়া ছাড়া চোখের সামনে অনেকক্ষণ আর কিছুই ছিল না, যারা দেখেছিল ওই সন্দেহজনক দ্রুতগতির যানটিকে, তারা বলেছিল যুদ্ধের কথা।

আমেরিকা পাকিস্তানকে দিয়ে নাকি আমাদের মেরে ফেলার জন্য এই আধুনিক আকাশযান পাঠিয়ে দেখে নিচ্ছে ভারতবর্ষের মাটি কত পলকা। হতে পারে আবার বিশ্বযুদ্ধ। চিন আবার ভারত আক্রমণ করবে। ওই যে জাহাজটির নৈঃশব্দভরা রহস্যজনক উড়ে যাওয়া সবই এক গভীর প্রস্তুতি। পুব আকাশ থেকে টানা ধোঁয়ার রেখা পশ্চিম দিগন্তে গোধূলিতে মিশেছে, চেয়ে দেখতে দেখতে আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারও কারও ঈষৎ আতঙ্কও জেগেছিল। দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধের অতীত অভিজ্ঞতা, দুর্ভিক্ষ, মারি, ক্ষুধা আর বেকারত্ব গ্রামের মানুষকে কোনও দিনই বিজ্ঞানের আকাশচুম্বী শক্তির প্রতি আস্থাশীল হতে দেয়নি। একটি জেট বিমানের সঙ্গে আমাদের যেদিন প্রত্যক্ষ অনুভূতির যোগ ঘটেছিল, সেদিন সর্বগ্রাসী এক বৈজ্ঞানিক বিস্ময় গ্রামের হৃদয়ে অদ্ভুত বিপন্নতার জন্ম দিয়েছিল। এর ফলে বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারেনি। অপু-দুর্গার প্রথম রেলগাড়ি দেখার অভিযানে যে রোমাঞ্চ-রোমান্টিকতা ছিল, আমার ছেলেবেলায় জেট-জাহাজ দেখার মধ্যে সেই ঘোর ছিল না। বরং ওই বিমান দেখে আমার মধ্যে এক অপ্রকাশ্য ঘৃণার জন্ম হয়েছিল। একথা আমার স্পষ্ট মনে আছে।

আজ বোধহয এমন কোনও গ্রাম নেই, যে গ্রামে টেলিভিশন পৌঁছোয়নি। গ্রামের কোনও এক কৃষক যখন টিভির পর্দায় ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার মর্মান্তিক ছবি প্রত্যক্ষ করেন, তখন তাঁর মনে বিজ্ঞানের কলাকৌশলের প্রতি স্নেহ জেগে ওঠার কোনও অবকাশ তৈরি হয় না। সুবোধ ঘোষের অযান্ত্রিক গল্পে হাওয়াগাড়ির উপর মানুষের মমত্ব শুধু কোনও কল্পনা নয়, ওই মোটরগাড়ি এবং (মানুষের জীবিকাগত উৎসের কারণে) তার চালকের অবস্থান হয়েছে সমানুভূমিক, কিন্তু ভোপালের কারখানা সহসা বিজ্ঞানের সীমাহীন নাশকতার বিভীষিকা সৃষ্টি করেছে, মানবপ্রাণের সঙ্গে যন্ত্রের বৈরিতা যেন এক সত্য-সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই অবস্থায় বৃদ্ধের উক্তিই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, বিজ্ঞান হল তামাশার জিনিস!

ফলে গ্রামের ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধ, নবির দোহাই দিয়ে বিজ্ঞানের দুর্বার গতিকেই অস্বীকার করতে চেয়েছেন। বিজ্ঞানের গতি যে আসলে দুর্গতি, সেকথা মানুষ জীবনের মর্মকোষে বিধিয়ে নিয়েছে অকাট্য অভিজ্ঞতায়। ভীত, অবিশ্বাসী মানুষকে সামনে টেনে নিয়ে চলা সহজ নয়, পশ্চাতে ঠেলে ফেলা সহজ।

যন্ত্রের প্রতি মানুষের এই অবিশ্বাস কেন? আজ যন্ত্রই সভ্যতার পট পরিবর্তন করেছে। গ্রামবাংলার পুরোনো অর্থনৈতিক জীবনে যন্ত্র ঢুকে পড়েছে ক্ষিপ্রবেগে। বন্যার বছরগুলিতে একসময় ত্রাতারূপী লাল হেলিকপ্টার উড়তে দেখেছি, ওই রক্তরঙিন যন্ত্র থেকে খাবারের প্যাকেট ছুড়ে দেওয়া হয়েছে বন্যার্ত মানুষের মুখে, বন্যার জল সরে যাওয়ার পর দেখেছি ফসল খোয়ানো চাষির জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে লাল টুকটুকে এক কলের লাঙল, ট্র্যাক্টর! আর আবাদ বয়ে নিয়ে যাওয়ার ট্রলিও অগুনতি চাষিবাসীর গোয়ালে যুদ্ধ বাধিয়েছে অকাট্যভাবে। বাঘে আর গোরুতে একই ঘাটে জল খায় না, কিন্তু একই মাঠে চাষে নেমেছিল লালী বলদ আর লাল কল!

যন্ত্র জোতদারকে দেয় পুঁজি। একজন গরিব চাষি তার স্বল্প জমি চাষ করার পর লাঙল-বলদ ভাড়া খাটিয়েছে অন্যের জমিতে। তার গোরুর গাড়ি ভাড়া খেটেছে অন্যের মাল আবাদ বইবার জন্য। ট্র্যাক্টর আসার পর সেই গরিব চাষিকে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছিল যন্ত্রের সঙ্গে। লাখ টাকার যন্ত্রের সঙ্গে হাজার টাকার গোরুর এই বিষম লড়াই একটি দরিদ্র চাষির মনে যে ভয় এবং অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছিল, তার কোনও লেখাজোখা নেই। পুঁজির সঙ্গে পুঁজিহীনের এই বিসংবাদ যন্ত্র-কৌলীন্যের অভিশাপ বলে মনে হয়েছিল গ্রামের মানুষের কাছে।

আমি এক গরিব চাষিকে জানতাম, যার নাম ছিল আউলাদ মির। এই মানুষটির শোভা বলতে ছিল একজোড়া তেজি দুর্দান্ত বলদ। পুরোনো কংগ্রেসি ভোটের বলদের চেয়ে তাজা আর স্বাস্থ্যশালী। চেয়ে দেখে দু’চোখ জুড়িয়ে যেত। মিরের ছিল গাঁ-জোড়া খ্যাতি, ওঁর হাতে পড়লে খেঁকুড়ে-ঝানকা-ঝোরা গোরুও নাকি ওই ধারা হত, গোরুর গায়ে চমকে উঠত স্বাস্থ্যের বিজুরি। গোরুর গা চমকানি যারা দেখেনি, তারা মিরের সুনাম বুঝবে না! এই মানুষটিকেই একদিন পরাজিত ভঙ্গিতে বলতে শুনেছি– আরে ভাই, দেবনাথের কলের গোরু তো আর ঘাস খায় না, তেল খায়। একর একর চষতে তেনার একবেলা, আমার কাঠা কাঠা চষতে ফজর থেকে মগরিব (অর্থাৎ সকাল থেকে সন্ধ্যা)। আমার আর গোরু-বলদের উপর স্নেহশ্রদ্ধা নেই। ওই দ্যাখো ধুঁকছে, মরাবাঁচা খোদার ইচ্ছে।

এই অশ্রদ্ধা চাষি তার নিজের জীবনের প্রতি প্রকাশ করেছে। মির খুব সুন্দর করে সাজিয়ে কথা বলতেন, স্নেহ শব্দটি তিনি স্পষ্ট উচ্চারণ করতেন, বলতেন খুব মিয়োনো পরাস্ত গলায়– গোরুর বল বলো, চেহারা বলো, সব হল চাষার স্নেহ। সেই জিনিসটি উবে গেল বাপধন! আর নাই। কলের লাঙলের ধাক্কায় চাষা উলটে গেছে!

আর নাই বলতে বলতে তিনি অদ্ভুত শিশু-ঠকানো ভঙ্গিমা করে হাত নাড়তেন আর পরমুহূর্তে বুক চিতিয়ে উলটে পড়ার মুদ্রা রচনা-যোগে চোখ বন্ধ করে জিভ বার করতেন, যেন তিনি মরে যাচ্ছেন। গ্রামে কলের লাঙল ঢোকার পর এই দৃশ্যটি আমার মনে গেঁথে রয়েছে।

যন্ত্র আসলে তার প্রতিপক্ষ চায়। গরিব তার প্রতিপক্ষ। যেদিন ভৈরব নদীর পারঘাটায় স্টিমবোট নামল জলে সেদিনই হালধরা বৈঠাটানা মাঝি বেকার হয়ে গেল। দেখা গেল একখানি বাষ্পচালিত নৌকো  চালাতে মাত্র একজন চালক দরকার, যে ক্ষেত্রে লরি-বাস-যাত্রী বোঝাই নৌকো চালাতে দশজন মাঝিমাল্লার প্রয়োজন হত। অতঃপর সেই বেকার মাঝি কোথায় যায়, কী করে!

যন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারা হেরে যাওয়া মানুষ হামেশা একটি করে গল্প বানিয়ে ফেলে। সেই গল্প তৈরি হয় বিজ্ঞানের উলটো দিকে। বিজ্ঞানের যাত্রা যদি হয় একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পেরিয়ে তৃতীয় দশকের দিকে, তবে সেই গল্প চলে প্রস্তর যুগ অভিমুখে, যখন একজন মানুষ পশু শিকারের জন্য একটি চিকন কুঠার বানিয়ে ফেলে অথচ আকাশে জেট চালানোর চেয়ে অধিক উল্লাস অনুভব করেছিল। এই মানুষের জন্য ছিল রূপকথার লোকগুলি। সেই কাহিনীতে জেট বিমানের বদলে একটি চাষির ছেলের জন্য রয়েছে মনপবনের নাও। এমনকি সেই চাষির ছেলে অবশেষে সেই কাহিনীতে চাষির ছেলেও যে নয়, মানুষ হয়েছে চাষির ঘরে বা জেলেপাড়ায়, দুর্গ্রহে বিপাকে পড়ে তার এই চাষিজীবনে এসে পড়া– আসলে সে রাজার ছেলে। রূপকথার এই চমক না হলে চাষির মনও সন্তুষ্ট হয় না। চাষির কল্পনাতেও পক্ষীরাজ ঘোড়া রাজপুত্রের জন্যই উপযুক্ত, তার নিজের জন্য নয়।

আকাশবিহারী বাষ্পীয় রথে চড়ার শখ মির আউলাদের কুত্রাপি ছিল না। আজও নেই। ভারতবর্ষ বিজ্ঞানের পরামর্শ নেয়নি বহুদিন। গরিব চাষির ঘরে ট্র্যাক্টরও সেই অর্থে ঢুকেছে ঢের দেরিতে। লাঙল-বলদ সম্বল করে সে দিন কাটিয়েছে বহুকাল। দ্বিধাগ্রস্ত চাষি ক্রমশ যন্ত্রবিরোধী মানসিকতার এক অদ্ভুত চাষিতে পরিণত হয়েছিল। ফলে সেই চাষি দিনে দিনে আরও ক্ষুদ্র হয়েছে। সুদিনের সুযোগ ষোলোআনা পৌঁছে দিতে হলে চাষির ঘরে, চাষির ব্যাটাকেও দিতে হবে যোগ্য সুশিক্ষা। উন্নত ধরনের উন্নত মানের কৃষিবিজ্ঞানের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটাতে হবে।

ইদের রাতে আকাশে স্পুটনিকের রহস্যময় আলো চোখে পড়ে। সেই স্পুটনিকের আলোর দিকে চেয়ে থাকে গ্রাম, চেয়ে থাকে। চন্দ্রযানের চাঁদে পৌঁছোনোর আকাশচুম্বী ক্ষমতা আজও কি সব গ্রাম, গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে? জানি না।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img
[td_block_21 custom_title="LATEST POSTS"]

Most Popular