উত্তর সম্পাদকীয়

সংসার মাতানো জীবন্ত সরস্বতীরা

  • অবন বসু

আসমুদ্র ওপরচালাকি জানলেও, মানুষ প্রকৃতপক্ষে এক বিরল গোত্রীয় গণ্ডমূর্খ প্রাণী। নইলে উপনিষদের পাতা ঘেঁটে ‘সরস্বতী’ নামে কবেকার এক জ্ঞানের দেবীকে এমন বাড়াবাড়ি রকমের পুজোআচ্চার পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে কেউ? আচ্ছা, তাও নয় হল। সাহেবরাই যখন এই দেবীর পাশ্চাত্য রূপটিকে ‘দ্য গডেস অফ উইজডম’ বলে স্বীকার করেন, তখন আমরাই বা পিছিয়ে থাকি কেন! কিন্তু তা-ই যদি হবে, তাহলে এই উপমহাদেশে স্ত্রীশিক্ষার হার এত ন্যক্কারজনকভাবে নিম্নমুখী কেন?

আসুন একটু দেখা যাক, ভারতের নারীশিক্ষা সংক্রান্ত তিন বছর আগের একটি পরিসংখ্যান আমাদের দেশীয় কন্যারত্নদের বিদ্যালয় যাত্রার চিত্রটিকে কীভাবে আঁকছে। পঞ্চম, সপ্তম ও দ্বাদশ-ঊনবিংশ বর্ষীয়াদের উপস্থিতির হার এদেশে যথাক্রমে ৯২ শতাংশ, ৫১ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ মাত্র! অর্থাৎ সরস্বতী অর্চনার এত ঘনঘটাও কি না আদ্যোপান্ত একটা জঘন্য ঠাট্টার বেশি কিছু নয়!

যদিও এমনটা ভাবার কারণ নেই যে, মৃদু পরিহাসের এই তিরটুকু কালকের সরস্বতীপুজোর অছিলা ধরে স্রেফ সনাতন ধর্মের দিকেই ফেরানো। কেননা, ‘ভারতের সার্বিক স্ত্রীশিক্ষা’ বলতে তো একই শামিয়ানার নীচে সকল ধর্মবিশ্বাসীর উপস্থিতিই বোঝায়। উপরন্তু, এদেশের বিদ্যাদেবীর প্রভাব থেকে যোজন যোজন ক্রোশ দূরের এক মরুদেশাগত ধর্মবিশ্বাসীদের কন্যাগণও যে এই একই যাত্রায় ষোলোআনা সমবঞ্চনার শিকার, তারই সপক্ষে নয় একেবারে সাম্প্রতিক একটি ‘আই ওপেনার’ গোছের ঘটনার কথা তুলে ধরি। এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার দ্বিতীয় দিনে ফরাক্কা এলাকার জনৈক দুঃসাহসী কিশোরী তাহরিমা খাতুন হঠাৎ নিজের অসীম মনোবলে ভর করেই, সকাল সওয়া ১০টা নাগাদ ফরাক্কা থানার আইসি’র কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেছিল, ‘স্যর, আমি পরীক্ষা দিতে চাই। আমার পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে। দয়া করে আমাকে পরীক্ষা দিতে সাহায্য করুন।’ এই কথা শোনামাত্রই তিনি তাকে তার পরীক্ষাকেন্দ্র অর্জুনপুর হাইস্কুলে পৌঁছে দেন এবং সেখানেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার জন্য অতিরিক্ত সময় মঞ্জুর করে। এদিকে, পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে পুলিশ তখনই গিয়ে মেয়েটির বাবাকে গিয়ে সতর্ক করে আসে- মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি যেন আর কখনও কোনওরকম বাধা না দেন!

আসলে পাঠকমাত্রই জানেন, ইদানীং বছরের পর বছর ধরে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন কোনও না কোনও তাহরিমা খাতুন অথবা তনিমা বসাক শিক্ষালাভ নিয়ে তাদের এই অনমনীয় জেদের কারণেই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে বসে। আমরা এ নিয়ে দু’দিন তাদের প্রশংসা করি, তারপর সব ভুলে যাই। কেননা, আমাদের মধ্যে তো আর কোনও বিদ্যাসাগর জন্মাবেন না, যিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরবেন শুধু মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর আর্জি নিয়ে। যিনি উনিশ শতকের মতো আদ্যিকালেও বাংলাজুড়ে ৩৫টি মেয়েদের স্কুল খুলবেন মোট ১৩০০ কন্যার শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে। এমনকি, তাতেও নিশ্চিন্ত হতে না পেরে, ‘নারীশিক্ষা ভাণ্ডার’ নামে এক তহবিল খুলে, পরিচিত-অপরিচিত সর্বজনের কাছে অর্থভিক্ষা চাইবেন, দরিদ্র মেয়েদের স্কুলছুট বন্ধ করতে চেয়ে। ওঁর দেহাবসানকালে ৩০ বছরের রবীন্দ্রনাথ এজন্যই না লিখে পারেননি-“অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, চার কোটি বাঙালি সৃষ্টি করতে গিয়ে বিধাতা হঠাৎ একজন পুরুষ সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন!”

সরস্বতী যেহেতু খুবই কম বয়সের কন্যারূপী এক দেবী, তাই তাঁর পূজার্চনার আগের দিনটিতে এইসব তাত্ত্বিক কথাবার্তা হয়তো একটু বেশি রকমেরই ওজনদার হয়ে যাচ্ছে। বরং এই ফাঁকে কোনও না কোনওভাবে জীবনপথে চলে আসা ক’জন জীবন্ত বিদ্যাদেবীর কথা বলি। সবার আগে যাঁর কথা বলতে হবে, তিনি মহাশ্বেতা দেবী। ১৯৮৯ সালে একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য ওঁর কাছে যেতে হয় আমায়। কিন্তু প্রথমেই সেই প্রস্তাবকে ‘অর্থহীন’ ঘোষণার পর, আমার চার প্রশ্নের জবাবে মাত্র ২০টি শব্দ শুনিয়েই যখন উনি উঠে পড়ছেন- তখন কী এক দুঃসাহসের বশেই হঠাৎ ওঁর সামনে হাসতে হাসতে আমি বলে উঠি, ‘মহাশ্বেতাদি, সকাল থেকে এ পর্যন্ত বহু ইন্টারভিউ নিয়েছি আজ। কিন্তু একটা সত্যি কথা না বলে পারছি না। আপনিই সেই তালিকার মধ্যে একমাত্র পুরুষ!’ না, ওই বিচিত্র ভাষণের পরেও উনি আমায় তাড়িয়ে দেননি তো বটেই, বরং পরবর্তী পর্যায়ে ওই স্মৃতির সুবাদেই ওঁর থেকে বহু স্নেহপ্রাপ্তি ঘটেছিল আমার।

২০০৩ সালে লেখালেখির মাধ্যমেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয় বাংলাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিকা খালেদা এদিব চৌধুরীর! এরপর প্রভূত পত্রবিনিময় পেরিয়ে কলকাতার বিধাননগর এলাকায় একবার তাঁর আগমনের সুবাদে, পাকাপাকিভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন আমার ‘খালেদা দিদি’ এবং তখনই ওঁর থেকে আমি জানতে পারি, কত প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে তবেই নিজের লেখক সত্তাটিকে তিনি বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন।

এই অধ্যায়ের বহুকাল পরে অধুনা ইংল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশের এক বিদুষী লেখিকা সাগুফতা শারমীন তানিয়ার বার্তা-সান্নিধ্যে আসি আমি- আন্তর্জাল মাধ্যমে এপার বাংলা ও ওপার বাংলার গত তিন দশকের সাহিত্য বিষয়ে ওঁর এক সুদীর্ঘ তথা মহামূল্যবান সাক্ষাৎকার পাঠের পর। সত্যি বলতে কী, ওই লেখাটির মতো সাহিত্যের এত সৎ ও সুচারু মূল্যায়ন এবং একনিষ্ঠ পাঠকসত্তার পরিচয় জীবনে খুব বেশি দেখা হয়নি আমার। তা, বয়সের বিচারে এই অধম প্রতিবেদক ওই লেখিকার চেয়ে অনেকটাই বড় হওয়া সত্ত্বেও, সহস্র মাইল দূরত্ব ডিঙিয়েও আমার শতলক্ষ কুর্নিশ পাঠিয়েছিলাম ওপারের ওই আগ্নেয় প্রমীলা প্রতিভাটিকে।

এবার একবার আমার অমল কৈশোরে ফিরতে চাই। কেননা, বিদ্যানুরাগের কথায় হঠাৎই পাটকাঠির মতো রোগা একটি মেয়ের মুখ ভেসে উঠছে আমার সামনে। আমি যেবার হাইস্কুলে উঠি- মানে ১৯৬৫-র এক সকালে বাবা যখন অফিস যাওয়ার জন্য বেরোচ্ছেন, তখন হঠাৎই মন্টু পাল নামে বাবার খুব চেনা এক রিকশাকাকু ওঁর রিকশায় চাপিয়ে ওই রোগা মেয়েটিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলেন- তখনই জানতে পারি, ওঁর ওই একমাত্র কন্যাটি এবার ক্লাস নাইনে উঠলেও, অভাবের জন্যই কাকু ওর পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ায়, গত ক’দিন ও স্নান-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, জীবনে সেই প্রথম বাবাকে অশ্রুপাত করতে দেখি ওই করুণ বৃত্তান্ত শুনে এবং এরপর স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত দু’বছর যাবৎ মেয়েটির বইখাতা, টিউশন ফি ইত্যাদি যাবতীয় খরচের ভার বহন করেন বাবা।

যাঁর নামোল্লেখ ছাড়া এই রচনা শেষ করা অবিধেয় মনে করি, এবার সেই মা সারদামণির কথা একটু বলি। যাঁর নামেই সরস্বতীর বাস, সেই পূর্ণালোকিতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাটি কী জানেন? হিন্দু-মুসলিম সহ অসংখ্য জাতপাতবিশিষ্ট ভক্তের উচ্ছিষ্ট তাঁকে রোজ নিজের হাতে পরিষ্কার করতে দেখে একজন যখন প্রশ্ন করেন, “কেন এমন চব্বিশ জাতের এঁটো ঘাঁটবে তুমি?”-মা তখন বলেছিলেন, “চব্বিশ কী গো! এ তো একই জাত। আমার সন্তান না ওরা সবাই?” হ্যাঁ, এই হল সকল ধর্মজ্ঞানেরও সেরা জ্ঞান- যা আমাদের জানিয়ে যায় : ঈশ্বর থাকেন শুধু মানব অন্তরে!

(লেখক সাহিত্যিক)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Ebrahim Raisi। ইরানের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ভেঙে পড়ল কপ্টার, খারাপ আবহাওয়ায় বিঘ্নিত উদ্ধারকার্য

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আজারবাইজান সীমান্ত থেকে ফেরার পথে দূর্ঘটনার কবলে পড়ল ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম…

7 hours ago

Money seized | হাওয়ালা ব্যবসায়ীদের ডেরায় হানা বিহার পুলিশের, নেপাল সীমান্ত রকসলে উদ্ধার ৯৪ লক্ষ টাকা

কিশনগঞ্জঃ নির্বাচনের মাঝেই ফের লক্ষ লক্ষ দেশি-বিদেশি টাকা উদ্ধার করল বিহার পুলিশ। রবিবার এই বিপুল…

8 hours ago

Cooch Behar | অক্সফোর্ডে সাফল্য কোচবিহারের মেয়ের, খুশির হাওয়া জেলাজুড়ে

কোচবিহার: এবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও সাফল্যের চিহ্ন রাখল কোচবিহার। শনিবার বিশ্বসেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ…

8 hours ago

Belacoba | রাস্তা নির্মাণে নিম্নমানের কাজের অভিযোগ, প্রতিবাদে তুমুল বিক্ষোভ গ্রামবাসীদের

বেলাকোবাঃ রাস্তা নির্মাণে নিম্নমানের কাজের অভিযোগে সরব হলেন গ্রামবাসীরা। ঘটনাটি জলপাইগুড়ির সদর ব্লকের বেলাকোবা গ্রাম…

9 hours ago

Raiganj | ত্রিপুরার ব্যবসায়ী খুন কাণ্ড, রায়গঞ্জ থেকে ধৃত মূল পাণ্ডা

রায়গঞ্জ: অবশেষে ধরা পড়ল ত্রিপুরার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী দুর্গাপ্রসন্ন দেব খুনের মূল পাণ্ডা রাকেশ বর্মন (৩৩)।…

9 hours ago

Kidnap | যুবতীকে অপহরণ! অপহৃতার খোঁজে তল্লাশি পুলিশের, গ্রেপ্তার মূল অভিযুক্তের কাকা

রায়গঞ্জঃ এক তরুণীকে অপহরণ করে অন্যত্র লুকিয়ে রাখার অভিযোগে মূল অভিযুক্তের কাকাকে গ্রেপ্তার করল রায়গঞ্জ…

10 hours ago

This website uses cookies.