উত্তর সম্পাদকীয়

রেখেছ বাঙালি করে, বিশ্বের করোনি

অংশুমান কর

হইহই করে আমরা উদযাপন করলাম কবিপক্ষ। শেষ হতে না হতেই আবার আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি নজরুলের জন্মদিনের উৎসব উদযাপনে। অন্তত সাতদিন ধরে চলবে নজরুল তর্পণ। এসবই হচ্ছে মূলত দুই বাংলায় আর পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেখানে যেখানে বাঙালিরা আছেন, সেখানে। কিন্তু যেখানে বাঙালিরা নেই? সেখানে কি আদৌ আমরা দেখছি এই দুই কবির জন্মদিন পালনকে কেন্দ্র করে কোনও উন্মাদনা?

২৩ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেছিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়র। পৃথিবীজুড়ে পালিত হয় এই দিনটি। এটি সমাদৃত বিশ্ব বই দিবস হিসেবে। তাহলে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের জন্মদিনটি কেন সীমায়িত হয়ে পড়ল কেবল বাঙালিদের মধ্যেই? সংখ্যা এবং সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণের হিসেব নিলে অন্তত রবীন্দ্রনাথ তো নিশ্চিতভাবেই শেক্সপিয়রকে পেছনে ফেলবেন। তাহলে?

২৫ বৈশাখ হাজির ছিলাম কালনায় একটি কবিপ্রণামের অনুষ্ঠানে। এ বছর রবীন্দ্রনাথের চিন ভ্রমণের শতবর্ষ। বিশিষ্ট সাহিত্যিক অনিল আচার্য সেখানে বলছিলেন ২০০৮ সালে তাঁর চিন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা। সে বছর বেজিং বইমেলার থিম কান্ট্রি ছিল ভারত। অনিল আচার্য বলছিলেন যে, ওই বইমেলায় রবীন্দ্রনাথ নিয়ে একটি অনুষ্ঠানে সংগঠক এবং ভারত থেকে যাওয়া প্রতিনিধিরা ছাড়া চিনা শ্রোতা ছিলেন তিনজন, যাঁরা সকলেই বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী।

শুনে মনে পড়ছিল রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষের সরকারি অনুষ্ঠানে বলা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাক’টি। তিনি বলেছিলেন, তাঁর সেই সময়ের বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছিল যে, রবীন্দ্রনাথকে আর কেউ পাশ্চাত্যে তেমনভাবে পড়ছেন না। সাধারণ অবাঙালি পাঠকরা অনেকেই তাঁর নামটুকু জানেন, এইমাত্র।

সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্র জন্মদিনেই বিখ্যাত দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ইয়ান জ্যাক একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন যার শিরোনামটি ছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর ওয়াজ এ গ্লোবাল ফেনোমেনান, সো হোয়াই ইজ হি নেগলেক্টেড’? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বলা কথাগুলিকেই যেন সমর্থন করছিল ইয়ান জ্যাকের নিবন্ধটি। জ্যাক লিখেছিলেন, পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের রচনার বিভিন্ন লাইন ও পংক্তিতে সমৃদ্ধ দুটি শ্রেষ্ঠ কোটেশন ডিকশনারিতে (যার একটি অক্সফোর্ড এবং একটি পেঙ্গুইন প্রকাশিত) রবীন্দ্রনাথের রচনার একটি অক্ষরও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। জ্যাক দুঃখ করে এও লিখেছিলেন যে, দুই বাংলায় যাঁকে নিয়ে উন্মাদনা আজও অতি তীব্র, তাঁর দিক থেকে বাকি পৃথিবী প্রায় মুখ ঘুরিয়েই নিয়েছে। ১৩ বছর পরে, আজ এই ২০২৪ সনে, পরিস্থিতির কি তেমন পরিবর্তন হয়েছে? সাধারণভাবে ভারতবর্ষের বাইরের পাঠক কি পড়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্র? বাঙালি চিন্তকদের বাইরে আর কতজন পণ্ডিত পৃথিবীর নানা সমস্যাকে বুঝতে আজ ফিরে ফিরে যান রবীন্দ্রনাথের কাছে? প্রশ্নগুলির উত্তর খুব আশাব্যঞ্জক হবে না।

এমনটা হল কেন? উইলিয়াম শেক্সপিয়রের সঙ্গে তুলনা টেনেছি বলে অনেকেই বলতে পারেন যে, শেক্সপিয়রের পেছনে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে থেকেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থন। ব্রিটেন শুধু একের পর এক দেশ দখলই করেনি, সমস্ত দেশে পৌঁছে দিয়েছে তাদের কবি ও নাট্যকারকে। ঠিক। কিন্তু সারা বিশ্বে যেভাবে তলস্তয় বা দস্তয়েভস্কি পড়া হয় আজও, রবীন্দ্রনাথ কি সেভাবে পঠিত হন? শুনলে আশ্চর্য মনে হতে পারে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবনকালেই ক্রমশ পাশ্চাত্যের একাংশের কবি ও বুদ্ধিজীবীরা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন। যে ইয়েটসের ভূমিকা রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি এবং একদা পাশ্চাত্যে আইকন হয়ে ওঠার পেছনে অনস্বীকার্য, ১৯৩৫ সালে সেই ইয়েটসই লিখেছিলেন, ‘ড্যাম টেগোর,’ তাঁর সেই সময়কার লেখাকে বলেছিলেন ‘সেন্টিমেন্টাল রাবিশ’।

১৯৫৬ সালে বন্ধু রবার্ট কঙ্কোয়েস্টকে ফিলিপ লারকিন লিখেছিলেন যে, এক ভারতীয় রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চেয়েছেন এবং তাঁর মনে হচ্ছে যে, একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে তাতে কেবল একটি চার অক্ষরের শব্দ তিনি লিখে দেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে। ভাবা যায়!

একথা ঠিক যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতার খুব উন্নতমানের অনুবাদ বিরল। তাঁর কবিতার মধ্যে স্থানিক এত গূঢ়ে প্রোথিত এবং এতই অবলীলায় তা আন্তর্জাতিকও যে, এই দুইয়ের সামঞ্জস্য অনুবাদে রক্ষা করা কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভব। কেবল ‘কবি’ বা ‘বিশ্বকবি’ তকমায় রবীন্দ্রনাথকে আটকে রেখে জাতি হিসেবে আমরা তাঁর প্রতিভার প্রতি প্রবল অন্যায় করছি। শেক্সপিয়রকে সারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে দিতে ব্রিটিশ জাতির যে উদ্যম ছিল, রবীন্দ্রনাথের বহুবিধ সৃষ্টিকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে সেই উদ্যমের কণামাত্র আমরা দেখিয়েছি কি? তাঁর গান এবং কবিতা আমাদের বাঙালিদের পরম আশ্রয়। কিন্তু গোটা পৃথিবীর কাছে এই দুটি জিনিস তেমন আদর নাও পেতে পারে। বরং অনুবাদের জটিলতা কম বলেই সমাদৃত হতে পারে তাঁর অন্য রচনা। গত তিরিশ বছরে আমরা কি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পগুলির, গোরার মতো উপন্যাসের, দেশ, সমাজ ও শিক্ষা সংক্রান্ত একাধিক প্রবন্ধ আর চিঠিপত্রর আন্তর্জাতিক মানের অনুবাদ করে বহুজাতিক প্রকাশনার সংস্থাগুলির মাধ্যমে সেই কাজগুলিকে সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি? স্পষ্ট উত্তর হল, না।

কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের ভূমিকাও এক্ষেত্রে অত্যন্ত হতাশাজনক। কেন্দ্র সরকার বিভিন্ন দূতাবাসের মাধ্যমে নমো-নমো করে কবিপক্ষের রবীন্দ্রপুজো করেই দায়িত্ব পালন শেষ মনে করে। পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই টেগোর চেয়ার আছে। এই বিষয়ে কি কেন্দ্র সরকারের বিভিন্ন সংস্থার আরও উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজন ছিল না? কেনই বা রবীন্দ্রনাথ সংক্রান্ত গবেষণায় বিদেশি গবেষকদের আকর্ষণ করতে উপযুক্ত ফেলোশিপ প্রদান করার কোনও ব্যবস্থা আজও গ্রহণ করা হল না? যদি ফুলব্রাইট ফেলোশিপের সঙ্গে নেহরুর নাম যুক্ত হতে পারে, তাহলে কেবল রবীন্দ্রনাথের নামেই একটি সেই মাপের ফেলোশিপ চালু করার দায়িত্ব কি কেন্দ্র সরকারের ওপর কণামাত্র বর্তায় না?

একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি আদায় করেছিল কারণ ইউনেসকোর মঞ্চে বাংলাদেশের সরকার এই প্রস্তাব রেখেছিল। কেন্দ্র সরকার কি রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে একটি দিবসকে যুক্ত করার এই ধরনের কোনও প্রস্তাব ইউনেসকোতে রাখতে পারে না?

আমাদের রাজ্য সরকারের অবস্থাও তথৈবচ। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, রবীন্দ্রনাথকে আজকের পৃথিবীর জন্য উপযুক্ত আকারে বাইরের পৃথিবীতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকাই নেই গত তিরিশ বছরে। রবীন্দ্রনাথের বাছাই করা ছোটগল্প, প্রবন্ধ, চিঠিপত্রের ইংরেজি অনুবাদের প্রামাণ্য সংকলন কি রাজ্য সরকারের কোনও আকাদেমি প্রস্তুত করতে পারে না? সারা পৃথিবীজুড়ে তার বিপণনের দায়িত্ব নিতে পারে না? আমাদের রাজ্যেই এই কাজ করার জন্য যোগ্য মানুষজন এখনও আছেন। অভাব উদ্যমের।

রবীন্দ্রনাথেরই যদি এই অবস্থা হয়, নজরুলের অবস্থা কী আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে আজও পর্যন্ত পর্যাপ্ত গুরুত্ব নজরুল পাননি। রাজ্য সরকার একটি আকাদেমি করেছে ঠিক, কিন্তু সেই আকাদেমির কাজের গতি বড়ই শ্লথ এবং বাংলা-কেন্দ্রিক। কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নজরুল গবেষণা ও চর্চা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। চমৎকার কাজ শুরু করেছিল এই কেন্দ্রটি। কিন্তু এখন যথারীতি ঝিমোচ্ছে। এই কেন্দ্রের পাশ করা প্রোজেক্টের টাকা আটকে রেখে দিয়েছে রাজ্য সরকার, এমনটাই অভিযোগ। ভালো হোক বা মন্দ হোক রবীন্দ্রনাথের তো তাও অনুবাদ আছে। নজরুলের একাধিক লেখা এখনও অনুবাদ হয়নি। আমাদের কোনও দায় নেই?

কাজেই রবীন্দ্রনাথকে কেবল ‘বিশ্বকবি’ তকমায় দাগিয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে আজ আর চলবে না। নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি এই তথ্যে শ্লাঘা অনুভব করার দিনও শেষ। এঁদের প্রকৃতই বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে হলে, কিছু কাজ করতে হবে। সত্বর।

(লেখক সাহিত্যিক ও অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Prince-Yuvika | সন্তান আসতে চলেছে প্রিন্স-যুবিকার সংসারে, সুখবর দিলেন তারকা দম্পতি

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: পরিবারে আসতে চলেছে নতুন সদস্য। বাবা-মা হতে চলেছেন প্রিন্স নারুলা ও…

9 mins ago

Buffaloes smuggling | পাচারের আগেই পুলিশের জালে, কিশনগঞ্জ থেকে উদ্ধার ১৫৯টি মোষ, গ্রেপ্তার ৮

কিশনগঞ্জঃ বাংলাদেশে পাচারের আগেই উদ্ধার ১৫৯টি মোষ। মঙ্গলবার রাতে এই মোষগুলিকে উদ্ধার করে কিশনগঞ্জের কোচাধামন…

25 mins ago

Ananta Maharaj | ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা! মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর দিল্লিতে শায়ের দরবারে অনন্ত

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরই এবার দিল্লিতে অমিত শায়ের সঙ্গে দেখা করলেন…

26 mins ago

অম্বুবাচী ছাড়তেই পুজো শুরু শতাব্দী প্রাচীন আদি কামাখ্যাধামে, ভিড় পুণ্যার্থীদের

কামাখ্যাগুড়ি: সকাল থেকেই পুণ্যার্থীদের ঢল নামল মধ্য কামাখ্যাগুড়ির শতাব্দী প্রাচীন আদি কামাখ্যাধামে। দূর-দূরান্ত থেকে দলে…

26 mins ago

Kishanganj | পুকুরে স্নান করতে গিয়ে মর্মান্তিক পরিণতি! ডুবে মৃত্যু হল চার কিশোর-কিশোরীর

কিশনগঞ্জঃ পুকুরে স্নান করতে গিয়ে মর্মান্তিক পরিণতি! জলে ডুবে মৃত্যু হল চার কিশোর-কিশোরীর। বুধবার দুপুরে…

48 mins ago

Gazole | বাইকে লুকোনো থরে থরে গাঁজা, শিলিগুড়ির বাসিন্দাকে গ্রেপ্তার করল গাজোল পুলিশ

গাজোল: গোপন সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে জাতীয় সড়কে নাকা তল্লাশি চালিয়ে ১৬ কেজি ৮০০ গ্রাম…

52 mins ago

This website uses cookies.