উত্তর সম্পাদকীয়

অভিনেত্রীরাও ভুগছেন ‘বাবুন সিনড্রোমে’

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

ধরা যাক, প্রিয় পাঠক আপনি একটি বাংলা ছবি পরিচালনার স্বপ্ন দেখেন। বাঙালি তরুণ আগে গণহারে কবিতা লিখতে চাইতেন, এখন ছবি করতে চান বেশি। কবিতা লিখে কোনও প্রচার নেই, টাকা নেই। সিনেমা পরিচালনায় দুটোই ভালো অঙ্কের মেলে। সিনেমা পরিচালনার ভাবনা শুরু থেকে প্রচার মেলে, ফার্স্ট লুকে প্রচার, ফার্স্ট টিজারে প্রচার, প্রেস মিটের ঘোষণায় প্রচার, আমন্ত্রিত শোয়ে প্রচার, প্রথম শোতে প্রচার।

সে যাক গে। পরিচালনা না হয় করবেন, এবার প্রশ্ন, নায়ক-নায়িকা হিসেবে কাকে নেবেন? কাদের বাজার রয়েছে যে এক কথায় হাউসফুল হয়ে যাবে দিনের পর দিন? এখন আর শুধু টিকিট বিক্রির ওপর তো কিছু হয় না, সিনেমা বিক্রি করতে হবে টিভি চ্যানেলকে। সেটাই বড় বাজার। এবং মাত্র দুটো চ্যানেল রয়েছে বাংলা ছবি কেনার জন্য।

পাহাড়প্রমাণ সমস্যা এখানেই। দেব, জিৎ এবং কিছুটা যিশু ছাড়া কোনও নায়কের তেমন বাজার নেই যে, তাঁর নামে চ্যানেল মারাত্মক উৎসাহিত হবে। নায়িকা? এবার একেবারে মাথায় হাত। একজনও নেই, যাঁর নামে বক্স অফিসে ভিড় হবে। চ্যানেল ছবিটি কেনার জন্য উদ্বাহু হয়ে পরিচালককে তাড়া দেবে বারবার।

নায়িকাদের ক্ষেত্রে আরও আরও অনন্ত শূন্যতা।

কোনও নায়িকার টলিউডে বাজার নেই, এটা কি এবারের ভোটবাজারে নায়িকাদের দেখে বুঝতে পারবেন? তাঁরা তৃণমূল ও বিজেপি দুটো দলের কাছে তোল্লাই পেয়ে নিজেদের বিশাল কিছু ভাবছেন। অথচ গত পাঁচ বছরে ক’টা সিনেমা করেছেন সন্দেহ। সিনেমা এসে হল থেকে উঠে গিয়েছে ক’দিনে, খেয়াল করেননি কেউ।

প্রথমে সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক অভিনেত্রীর কথা বলি। তৃণমূল ব্রিগেডে লোকসভা প্রার্থীর নাম ঘোষণা করার পরদিন তিনি পার্টির সব পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। ওরে বাবা, পদত্যাগ। কী ব্যাপার? না, তাঁকে কেন লোকসভার প্রার্থী করা হয়নি? সেদিনই আবার ডিগবাজি খেয়ে পদত্যাগ প্রত্যাহার সায়ন্তিকার। তবে একটা বড় প্রশ্ন তুলে দিয়ে।

লোকের উচ্চাশারও একটা পরিমিতিবোধ থাকে, থাকে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা। বাংলার অভিনেত্রী-নেত্রীকুলের অধিকাংশেরই কি সেটা নেই? এবং সেই দায় নিতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-শুভেন্দু অধিকারী-দিলীপ ঘোষ-অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়দের। এমন কয়েকজনকে যাঁরা টিকিট পাইয়ে দিয়েছেন, অন্যরা দেখে ভাবছেন, আমি নই কেন? হাম কিসিসে কম নেহি। ভেবে দেখুন তো, সায়ন্তিকা ক’টা হিট সিনেমা দিয়েছেন বাংলায়।

এই যে সায়নী ঘোষকে দেখুন। গত কয়েক বছরে হাতেগোনা ফ্লপ সিনেমা। টলিউডে কার্যত ব্রাত্য। তিনি পর্যন্ত প্রার্থী হয়ে বসেছেন। আগে পুরসভার টিকিট, পরে বিধানসভা–হলে তাও কথা ছিল। একেবারে লোকসভায় প্রার্থী। এমন একটা কেন্দ্রে, যেখানে অতীতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণা বসুরা প্রার্থী হয়েছেন। এখানেই বাঙালির রাজনীতির অধঃপতনের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অভিনেতা হলে যে নেতা হওয়া যাবে না, এই মত হাস্যকর। অবশ্যই যে কোনও পেশার লোক লোকসভায় প্রার্থী হতে পারেন। তবে নিজের যোগ্যতা না বুঝেই লোকসভায় যেতে চাওয়ার ইচ্ছেটা চরম বোকামি। তৃণমূল ও বিজেপি সেই পথটা গণহারে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলায়। সিপিএম অতীতে অনিল চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমারকে দাঁড় করিয়েছিল। সেটা বিধানসভায়। এবং অনিল-অনুপের মতাদর্শ, আভিজাত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা ছিল না। জুন মালিয়া ভালো খাটছেন দলের হয়ে। টলিউডে কোনও কাজ নেই। তাই রাজনীতিতে অনেকটা সময় দিয়েছেন, ভালো কথা। তাই বলে লোকসভায়? আসলে এই পদ এখন এত সহজ হয়ে গিয়েছে, যে কেউ দাবিদার। শান্তনু সেন, প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ বলেই ফেললেন, টিকিট না পেয়ে রাতে শুয়ে কান্নায় বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছেন। হায় রে, জনতার জন্য কত চিন্তা! ‘জনসেবা’ করা হল না।

নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা না থাকায়, নিজেদের বিশাল ভেবে ফেলা অনেক অভিনেত্রী বিজেপিতেও রয়েছেন। তাঁরা ভাবছেন, লকেট চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেত্রী এমপি হলে আমি হব না কেন? শেষমুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন, যদি নাম ওঠে। তৃণমূলে সায়ন্তিকা-সায়নী-জুনরা যেমন ভেবেছেন, মিমি-নুসরত হলে আমি কেন নই?

গত বিধানসভা নির্বাচনে রূপা-লকেটের সঙ্গে কতজনকে দেখা গিয়েছিল বিজেপিতে। শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জনা বসু, পার্নো মিত্র, রিমঝিম মিত্র, তনুশ্রী চক্রবর্তী, কাঞ্চনা মৈত্র, রূপা ভট্টাচার্য। অনেকে তখন ভাবতেন, তৃণমূলে যদি লাভলি মৈত্র-অদিতি মুন্সিরা এমএলএ হন, তা হলে আমি হব না কেন? এখন আবার অধিকাংশই ভ্যানিশ। শুধু সম্ভবত অঞ্জনা বসু ক্ষীণ আশায় রয়েছেন, যদি সাংসদ হওয়া যায়। সুভদ্রা মুখোপাধ্যায় তো বিজেপিতে যোগ দিয়ে আবার তৃণমূলে এসে মমতার কাছের লোক হয়ে গিয়েছেন। এঁরা অর্জুন সিংকেও হার মানাবেন ভাই!

কিছু নেতাও রয়েছেন এই দলে। তাঁদের জন্য অমিতাভ বচ্চনের লিপে কিশোরকুমারের বাংলা সুপারহিট ফিল্মি গানের মুখরাটা শোনানো যায়—‘সে এক দাঁড়কাকের সাধ হল কোকিলা সাজিতে, পড়ল ধরা কা কা রবে তার সে জারিজুরি।’ হেমা মালিনী, জয়া বচ্চন, শাবানা আজমিরা না হয় সর্বভারতীয় পর্যায়ে নামের জোরে সাংসদ হতে পারেন, তাই বলে এঁরাও সাংসদ হবেন?

দুঃখ ও যন্ত্রণার হল, এই বাংলা থেকে অতীতে হীরেন মুখোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মেঘনাদ সাহা, ত্রিদিব চৌধুরী, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, জ্যোতির্ময় বসু, সোমনাথ লাহিড়ী, প্রণব মুখোপাধ্যায়, ভূপেশ গুপ্ত, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রতাপ চন্দ্র চন্দ, অশোক সেন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিরা সংসদে যেতেন। হীরেন-জ্যোতির্ময়-ভূপেশরা যখন বলতেন, তখন নিজের দলের সদস্যদের চুপ করিয়ে দিতেন নেহরু বা ইন্দিরা। এখন সেই দৃশ্য হয় কোথায়? বঙ্গজ উত্তরাধিকার কোথায় নেমেছে। মহিলা বিল যাঁর হাত ধরে প্রথম আলো দেখেছিল, সেই গীতা মুখোপাধ্যায়ের শতবর্ষ চলছে এবার। আর এবছরই তাঁদের বাংলা থেকে কারা সংসদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এখন।

নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই, অথচ বিশাল স্বপ্ন দেখার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ মুখ্যমন্ত্রীর ছোট ভাই বাবুন। বাংলার খেলাকে ডকে তুলে দেওয়ার অন্যতম প্রধান নায়কেরও ইচ্ছে ছিল, তিনি নাকি লোকসভায় যাবেন। এখানে আবার সেই অনিল চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান মানায়–দাও, দাও, দিয়ে যাও। কিছুতেই লোভ যায় না এঁদের।

আপনার মুখ আপুনি দেখো ভাই আয়নায়। আমি কতটা যোগ্য হে? কেউ দেখে না। তাই মনে হয়, এখন সায়ন্তিকাদের প্রত্যেকের মধ্যে একজন করে বাবুন লুকিয়ে রয়েছে।

এই পর্যবেক্ষণের উলটো একটা দিক লুকিয়ে রয়েছে এখানে। ভেবে দেখুন, রাজ্যে সব পার্টিতেই নেতারা উপযুক্ত প্রার্থী পাচ্ছেন না। তাই দলবদলিয়াদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে প্রত্যেককে। রাজনীতিতে হয় ভালো লোক আসছেন না। কিংবা রাজনীতিতে এসে ভালো লোকেরা খারাপ হয়ে যাচ্ছেন।

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বা ফেসবুকে যেমন সিরিয়াস লেখার থেকে চটজলদি লঘু লেখার বাজার অনেক ভালো, তেমন দলবদলিয়া লঘু কথার নেতাদেরই বাজার ভালো প্রার্থীদের তালিকায়। অতীতে যে বিজেপিতে নেতাদের নিয়ে নানা বিধিনিষেধ থাকত, সেই বিজেপি দলবদল করে ফের দলবদলের পাত্র অর্জুন সিংয়ের জন্য অপেক্ষা করে। আর বলে না, আপনি আমাদের পার্টি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, আর কিছুতেই নেব না। মমতারও এক স্টান্স। যে কারণে বাবুল, মুকুল, অর্জুন, রাজীবদের জন্য দরজা খোলা রাখেন। প্রার্থী ঘোষণার ঘণ্টাখানেক আগে অর্জুন বা শুভেন্দু ভ্রাতা দিব্যেন্দু অধিকারীকে দলে নিয়েই দাঁড় করিয়ে দেন ভোটে। দিব্যেন্দুর নামটা পর্যন্ত মঞ্চের প্রধান নেতা গৌতম ভালো করে উচ্চারণ করতে পারেননি। মমতার পরিবার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু অধিকারী পরিবারের বাবা এবং তিন পুত্রের সুবিধেবাদ নিয়ে একেবারে চুপচাপ থেকে যান বিজেপি নেতারা।

এসব মজার ব্যাপার। আরও চর্চার ব্যাপার, এইসব দলবদলিয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী অনেক সময় অযোগ্য লোকেরা ভোটও পেয়ে জিতে যান। ভোট কারা দেন? আমরা নাগরিকরাই। তাঁরা তো বলতে পারেন, এই ধরনের লোককে আমরা ভোট দেব না। সেটা করেন না। তাঁদের নিয়ে তো প্রশ্ন তোলার জো নেই। নাগরিক অধিকার বলে কথা।

অতএব হে ভাই, চালাও পানসি বেলঘরিয়া। সুবিধেবাদ নগরীর সবাই বাবুন সিনড্রোমে ভুগতে থাকুক। আসুন, আরও এগিয়ে আসুন সায়ন্তিকা, শান্তনু, অর্জুন, দিব্যেন্দুর দল।

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Lok Sabha Election 2024 | ‘বিজেপির হাতই ধরতে হবে রচনাকে’, বললেন লকেট, পালটা যা বললেন তৃণমূল প্রার্থী

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সোমবার পঞ্চম দফা ভোট (Lok Sabha Election 2024) শুরু হয়েছে দেশের…

26 mins ago

Missing MP | ভারতে চিকিৎসা করাতে এসে বেপাত্তা বাংলাদেশের সাংসদ, ঢাকায় নিখোঁজ ডায়েরি পরিবারের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ কলকাতায় চিকিৎসা করাতে এসে নিখোঁজ বাংলাদেশের এক সাংসদ। নিখোঁজ সাংসদের নাম…

51 mins ago

PM Narendra Modi | রেকর্ড সংখ্যায় ভোটদানের আর্জি, পঞ্চম দফার আগে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট মোদির

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: লোকসভা নির্বাচনের (Lok Sabha Election 2024) পঞ্চম দফা শুরু হয়েছে দেশজুড়ে।…

53 mins ago

Iran President’s chopper Crash | ইরানের প্রেসিডেন্টের ভেঙে পড়া চপারের খোঁজ মিলল, কেউ বেঁচে না থাকার আশঙ্কা

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির ভেঙে পড়া চপারের (Iran President's chopper Crash)…

1 hour ago

Money seized | খড়গপুরে হোটেলে হানা পুলিশের, বিজেপি নেতার কাছ থেকে উদ্ধার ৩৫ লক্ষ টাকা

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ লোকসভা ভোটের মাঝে ফের উদ্ধার লক্ষ লক্ষ টাকা। এবার উদ্ধার হল…

2 hours ago

West bengal weather update | উত্তরে প্রাক বর্ষার বৃষ্টি, দক্ষিণবঙ্গে ৫০-৬০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: পঞ্চম দফার ভোট শুরু হয়েছে দক্ষিণবঙ্গে। ভোটের বাংলা দুর্যোগের পূর্বাভাস (West…

2 hours ago

This website uses cookies.