কৌশিক দাম
দুর্নীতি করে সাধারণ জনগণ, আর এর সুবিধা নিয়ে থাকে নেতা থেকে আমলা সবাই। সেই দুর্নীতি যখন সামনে আসে, তখন আবার মানুষই তার নিন্দা করে। এই জঘন্য ঘটনা ঘটতেই থাকে। খবরের কাগজের প্রথম পাতা থেকে হারিয়ে যেতে না যেতেই আবার আরও বড় দুর্নীতি সামনে চলে আসে।
শহরের ভালো একটা স্কুলে ভর্তি হতে গেলে সেই স্কুলেরই একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকার কাছে প্রাইভেটে ভর্তি হতে লাগত এক সময়। তিনি এমন দুর্ধর্ষ পড়াতেন তাতে তাঁর ব্যাচের সবাই সেই স্কুলে ভর্তি হতে পারত। এ গল্প ভীষণ পরিচিত আমার শহরে, অবশ্য এ অনেক কাল আগের গল্প। আজ বসে ভাবলে মনে হয় এও তো দুর্নীতিই ছিল, এরপর এত এত ব্যাক ডোর চোখে পড়ল যে, এইসব ছোটখাটোগুলোকে আর মনে রাখতে পারলাম না, আসলে আমাদের মগজ শুধু খারাপতর বিষয়গুলোকেই মনে রাখতে পারে।
ব্যাপক দুর্নীতি যখন শুনলাম তখন মনে হল বাঙালি আর যাই হোক এদিক দিয়ে অনেক পরিষ্কার। কিন্তু ক’দিন পরেই দেখলাম খাটের তলায় কোটি কোটি টাকা পাওয়া যাচ্ছে বাংলায়। নিজে শিক্ষক হয়ে লজ্জিত হয়েছি বারবার। ভাবলাম এই বোধহয় নিকৃষ্ট দুর্নীতি দেখলাম। তাই এবার শেষ। তারপরেই চোখে পড়ল আরও ভয়ানক এক দুর্নীতি। যারা ভবিষ্যতে ডাক্তার হবে, সেই নররূপী ভগবানদের নির্বাচন পরীক্ষার দুর্নীতি। খবরের কাগজে দেখলাম, হাজার কোটি নাকি ছাড়িয়ে যাবে এই দুর্নীতির টাকার অঙ্ক। হয়তো এই দুর্নীতিকে আর্থিক দিক থেকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে অন্য কোনও দুর্নীতি। যেটা পারবে না অতিক্রম করতে সেটা হল মূল্যবোধের অভাবকে।
যারা চাকরির জন্য দুর্নীতি করেছে তারা প্রত্যেকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, হয়তো বাড়ির লোক টাকা দিয়েছে। কিন্তু সেটাতে সম্পূর্ণ সম্মতি ছিল সেই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষটার। এই যে নিট দুর্নীতি, তার শিকার এক একটি স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা। যারা নিজে টাকা দেয়নি বা টাকা দেওয়ার জন্য বাধ্য করেনি তাদের অভিভাবককে। এখানে কোনও বাবা বা মা তার শিশুকে উলটো শিখিয়েছে, অর্থই শেষ কথা। এখন সেই বিজনেস ইনভেস্টমেন্টের প্রোডাক্ট যখন মার্কেটে আসবে, তখন সে সাধারণ জনমানুষে কী প্রভাব ফেলবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
সেদিনই কাগজে পড়লাম এক দিনমজুর ছেলেকে মোবাইল কিনে দিতে না পারায় ছেলে আত্মঘাতী হয়েছে। ভ্যানচালক বাবা অক্ষম কৃতী মেয়েকে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করতে।
এই দেশে বারবার অর্থের কাছে পরাজিত হয়েছে মেধা। এই প্রথম হয়তো একটা শুরু হল যেখানে বাবা-মায়েরা এগিয়ে এসে দুর্নীতিতে অংশগ্রহণ করল, আর কোটি কোটি অক্ষম বাবা চোখ মুছে তাদের সন্তানকে বলতে বাধ্য হল, ক্ষমা করিস আমাকে, আমি অযোগ্য, তুই না। এক অদ্ভুত বিকৃত বিক্রিত সমাজে আমরা বাস করতে শুরু করলাম, যেখানে বাবা-মা তার সন্তানকে মূল্যবোধের পাঠ না পড়িয়ে মূল্যর ক্ষমতার আস্ফালন শিখিয়ে গেল। আর কোটি কোটি বাবা-মার স্বপ্ন মূল্যহীন করে দিচ্ছে সেই শিক্ষা।
(লেখক জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। শিক্ষক)