উত্তর সম্পাদকীয়

পাকিস্তানে পিছনে ‘খেলছে’ সেই সেনা

  • কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

লাহোরের বড় বাজারের ফল বিক্রেতা শওকত আলি দৃশ্যত তাঁর উচ্ছ্বাস আর চেপে রাখতে পারছেন না। টিভি রিপোর্টার যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন, গত ৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে কাকে ভোট দিয়েছেন তিনি, তখন শূন্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বছর চল্লিশেকের সদম্ভ চিৎকার ‘কাপ্তান সাহাব ছোড়কে অউর কোই হ্যায় কেয়া ময়দানি জং মে?’

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও বলছেন পাকিস্তানের এই ভোটে ইমরান খান অন্তরিন। দৃশ্যত তাঁর কোনও উপস্থিতিই নেই এই ভোটে। না আছে কোথাও তাঁর ছবি, না কোনও দেওয়ালে পোস্টার, না রয়েছে তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর ব্যাট চিহ্ন। কিন্তু অদৃশ্যভাবে সর্বত্র ছেয়ে আছেন ইমরান খান নিয়াজি। তাঁর এই অন্তরিন হয়ে থাকাটা, তাঁর দলের ছোট-বড় প্রায় নেতাকে হয় জেলে পোরা বা অন্য দলে যোগ দিতে বাধ্য করাটা যে জনমানস ভালোভাবে নেয়নি, তা নির্বাচনের ফলেই পরিষ্কার।

সহানুভূতির ঝড়ে সওয়ার হয়ে পিটিআই প্রার্থীরাই নির্দল হিসাবে ভোটে লড়ে সেঞ্চুরি পার করে দিয়েছেন। এই লেখা পর্যন্ত ৭২টি আসন জিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে উঠে এসেছে নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) আর ৫৪টি আসন জিতে তৃতীয় স্থানে বেনজির তনয় বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)।

এখানেই বিস্তর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই পাক সংসদ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির এই নির্বাচনে লাগামছাড়া রিগিংয়ের অভিযোগ করতে শুরু করেছে ইমরান খানের দল। তাদের দাবি, বহু জায়গায় তাদের প্রার্থীদের জোর করে হারানো হয়েছে। খোদ ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও এই ভোট কতটা নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে লক্ষণীয় হল, নির্বাচনে কারচুপির ব্যাপারে পিএমএল-এন বা পিপিপি মৌনব্রত নিয়েছে। দু’দলের কেউই এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে সন্দেহটা দানা বাঁধছে এখানেই। তাহলে কি নওয়াজের ফিরে আসা, ভোটে ইমরানের দলকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস- সবই একসূত্রে বাঁধা? সবই কি আসলে নওয়াজকে ফের তখতে বসানোর আয়োজন?

এমনিতে পাক সংসদের নিম্নকক্ষ (উচ্চকক্ষ সেনেট) ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা আইন-ই-জাইরিনের সদস্য সংখ্যা ৩৪২-এর মধ্যে ২৬৬ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসেন পাঁচ বছর অন্তর। অর্থাৎ ইমরানের দল এখনও পর্যন্ত বৃহত্তম দল এবং সংসদীয় রীতিনীতি মেনে চললে পাক রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভির তাদেরই ডাকা উচিত।

ওয়াকিবহাল মহলের মতে, খেলাটা শুরু হয়েছে এখানেই। ইমরান খানের সমর্থকরা নির্দল হিসাবে জিতেছেন, কোনও দলীয় ব্যানারে নয়। ফলে নিয়মের ঘুরপথে তাদের রাজনৈতিক দল হিসাবে গণ্য নাও করতে পারেন পাক রাষ্ট্রপতি আলভি। তার মানে ভোটে হেরেও নওয়াজ শরিফের সামনে চতুর্থবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দরজা খুলে যেতেই পারে। কারণ আলভি বৃহত্তম দল হিসাবে শরিফের দলকেই মান্যতা দিতে পারেন, ইমরানের নির্দল জোটকে নয়।

অর্থাৎ পিটিআই-এর চেয়ারম্যান আলি গোহর খান যতই দাবি করুন, রাষ্ট্রপতি তাঁদের সরকার গঠনে ডাকবেন, বাস্তবে সেটা নাও হতে পারে। তাই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এই নির্বাচিত নির্দলদের যত শীঘ্র সম্ভব কোনও রাজনৈতিক ব্যানারের তলায় আসার উপর জোর দিচ্ছেন। একমাত্র তাহলেই পিটিআই সরকার গঠনের দাবি জানানোর জন্য পায়ের তলার জমি শক্ত করতে পারবে।

এত করেও রাওয়ালপিন্ডির কারাগারে অন্তরিন ইমরানের কপালে যে ফের পাকিস্তানের উজির-এ-আজমের শিকে ছিঁড়বে তার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ তাঁদের মতে, লাহোর করাচির গলির বাচ্চারাও জানে পাক প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে কে বসবেন তা আসলে নির্ধারিত হয় জনগণের ভোটে নয়, রাওয়ালপিন্ডির সেনাছাউনিতে। আর সেই সেনার সঙ্গেই বিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন কাপ্তান সাহাব। ২০২৩-এ তাঁর উজির-এ-আজমের কুর্সি খোয়ানো বা পরের মাসে তাঁর জেলযাত্রা আসলে সবই যে উর্দিধারীদের সৌজন্যে তাও বুঝতে কারও বাকি নেই। আর সেনার সঙ্গেই সম্পর্ক মেরামত করে নওয়াজ ফের প্রধানমন্ত্রিত্বের দরজা খোলার প্রতীক্ষায়। পাক রাজনীতির হালহকিকত যাঁরা জানেন, তাঁদের মতে, নিখুঁত অঙ্কের নিয়মেই খেল কুর্সিকা চলছে। সেনাই যে পাক রাজনীতির আসল নিয়ামক তাও বারংবার প্রমাণিত। এও পরিষ্কার যে সেনার অঙ্গুলিহেলনেই ২০১৭ সালে নওয়াজ শরিফ তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান এবং প্রথমে সৌদি আরব ও পরে লন্ডনে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। ইতিহাসের আশ্চর্য সমাপতন হল ২০১৬ সালে শরিফ দুজন সিনিয়ার জেনারেলকে ডিঙিয়ে যে ওমর জাভেদ বাজোয়াকে সেনাপ্রধান করলেন, তাঁর কথিত মদতেই শরিফ জমানা শেষ করে ইমরানের উত্থান হল।

বলা হয়, মূলত সেনাবাহিনীর মদতেই ২০১৮ সালের ভোটে ৯০ দশক থেকে চলে আসা পিপিপি ও পিএমএল-এনের মধ্যে ক্ষমতা দখলের মিউজিক্যাল চেয়ারের অবসান করে এতদিন প্রান্তিক দল হিসাবে পড়ে থাকা পিটিআই ১৫৬ আসন নিয়ে একক বৃহত্তম দল হিসাবে সংসদে আসে। তারপর আর খান সাহেবকে পিছনে তাকাতে হয়নি। ৬ সহযোগী দলের সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়া ছিল কাপ্তান সাহেবের কাছে সময়ের অপেক্ষামাত্র।

খান সাহেবের আসল হিসাবের ভুল হল ২০২১-এর অক্টোবরে এসে। পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধানের গুরুত্ব সেনাপ্রধানের পরই। খান হয়তো আশঙ্কা করেছিলেন, প্রথমবার ভোটের বৈতরণি পেরোতে বাজোয়া সাহায্য করলেও পরেরবার নাও করতে পারেন। ফলে আইএসআইয়ের তৎকালীন প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফৈয়জ হামিদের সঙ্গে দোস্তি করলেন। এই গোপন রফার খবর বাজোয়ার কানে ঠিকই পৌঁছাল। অঙ্কুরেই এই রফা শেষ করার জন্য হামিদকে তড়িঘড়ি আইএসআই থেকে সরিয়ে পেশোয়ারে পাঠালেন। ইমরান প্রথমে কিছুতেই এই বদলি মানবেন না বলে ধনুর্ভঙ্গপণ করলেও পরে অবস্থা বেগতিক দেখে মেনে নেন। তবে বাজোয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে চিড় ধরেই গেল।

ওয়াকিবহাল বলছে, ঠিক যে কায়দায় পিটিআইকে তোলা হয়েছিল, বছর পাঁচেক বাদে ছন্নছাড়া পিএমএল-এনকে একই কায়দায় অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। প্রথমে নওয়াজের ছোট ভাই শাহবাজকে প্রধানমন্ত্রী করা হল। কিন্তু তাতেও ঘরে বাইরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল সেনার পক্ষে। এর বড় কারণ নওয়াজ-কন্যা মরিয়ম কাকার বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ করে বসলেন। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে নওয়াজই তখন শেষ তাস সেনার কাছে। তাই লন্ডনে নির্বাসিত নওয়াজের দেশে ফেরার রাস্তাই শুধু খোলা হল না, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির সব অভিযোগও তুলে নেওয়া হল। ফলে ভোটে দাঁড়াতে নওয়াজের আর বাধা রইল না। পাশাপাশি ইমরানের থেকে ভোটে দাঁড়ানোর অধিকারই কেড়ে নেওয়া হল। ঠিক যেমন ২০১৮-র নির্বাচনে লড়ার অধিকার নওয়াজ শরিফের ছিল না। অর্থাৎ পুতুলনাচের কুশীলব বদলাবদলি হয়েছে, পিছনের নাচানেওয়ালা একই রয়েছে।

তাই ওয়াকিবহাল মহলের প্রশ্ন, এখন নওয়াজের কুর্সি আসীন হওয়াটাই কি আপাতত এই রাজনৈতিক চিত্রনাট্যের শেষ অঙ্ক নয়? ইমরান ফের ক্ষমতায় এলে অনেক অঙ্কই যে কেঁচে যেতে পারে।

পরিস্থিতি যা তাতে অঙ্ক মেলাতে নওয়াজ শরিফকে অতীতের তিক্ত ইতিহাস ভুলে হয়তো বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। বস্তুত সেই প্রক্রিয়া শুরুও হয়েছে।

তাহলে শেষমেশ কী দাঁড়াল? এবার ক্ষমতার অলিন্দে কাপ্তান সাহাব যদি নাও হাঁটতে পারেন, তাহলেও রাজনৈতিক দিক দিয়ে তাঁর কোনও লোকসান নেই। এই ভোটে সেনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জনসমর্থন তাঁকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তির আসনে বসিয়েছে। কে বলতে পারে এতে পাকিস্তানে প্রকৃত গণতন্ত্র আসার রাস্তাই সুগম হচ্ছে না?

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

উৎসব কই, বড় অসহ্য নির্বাচনের পরিবেশটা

গৌতম সরকার দিন যে আমার কাটে না রে...। কী যে যন্ত্রণা! কোথাও ভোট হয়ে গিয়েছে।…

2 mins ago

যে শালিক মরে যায় কুয়াশায়, সে তো আর…

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য সকালে এক শালিক দেখা মানেই বুক দুরুদুরু! এই রে দিনটা খারাপ হতে চলেছে!…

18 mins ago

আবেগের ভক্তিরস বনাম দারিদ্র্য

রূপায়ণ ভট্টাচার্য মন্দিরের মতো দেখতে রাজকীয় অযোধ্যা রেলস্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে একটি কাঠবেড়ালির…

28 mins ago

Supreme court | উপাচার্য নিয়োগে রাজনীতি বরদাস্ত নয়, বোসকে কড়া বার্তা সুপ্রিম কোর্টের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজনীতি বরদাস্ত নয়। স্পষ্ট জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট।…

45 mins ago

Gang rape case | চলন্ত ট্রেনে গণধর্ষণের শিকার মডেল! প্রায় ২ মাস পর অভিযোগ দায়ের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: চলন্ত ট্রেনে নেশার জিনিস খাইয়ে এক মডেলকে গণধর্ষণের (Gang rape case)…

49 mins ago

Hardik Pandya Banned | মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে দুঃসংবাদ! পরের আইপিএলে দলের প্রথম ম্যাচে নির্বাসিত হার্দিক

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: একে তো ঘরের মাঠে লখনউ সুপার জায়ান্টসের (Lucknow Super Giants) কাছে…

2 hours ago

This website uses cookies.