- দেবেশ চট্টোপাধ্যায়
১৯৯৮ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ ক্ষমতায় আসার পর নয়াদিল্লির জাতীয় সংগ্রহশালায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছিল। সংগ্রহশালার হরপ্পার গ্যালারি সংস্কার করে সেখানে সভ্যতার সময়সারণি প্রদর্শিত হয়। সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতা কোন সাল থেকে শুরু সেটা বিভিন্ন রঙের লাইন দিয়ে দেখানো হয়েছিল। যেমন চিনের সভ্যতা খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩২০০ থেকে শুরু, সুমেরীয় সভ্যতা খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১২০০ থেকে ইত্যাদি।
সবার উপরে একটি গেরুয়া রেখা যেটি সমস্ত ছাড়িয়ে ঘরজুড়ে রয়েছে, সেটি ভারতীয় সভ্যতা এবং তার সময়কাল দেখানো হয়েছে ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। অলীক সব তথ্য দিয়ে ইতিহাস পুনর্নির্মাণের চেষ্টা চলছে বহুদিন ধরেই, সাম্প্রতিক একটি ঘটনা তারই পুনরাবৃত্তি।
সম্প্রতি দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা আয়োজিত ‘ভারত রঙ্গ উৎসব’-এর অন্তর্গত ‘জন ভারত রঙ্গ’-এ অভিনয়ের জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন পারফর্মিং আর্টস-এর দলগুলির কাছে একটি বার্তা আসে। আগামী ২৯ ফেব্রুয়ারি দলগুলিকে ১০ থেকে ২০ মিনিটের পারফরমেন্স করতে হবে। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’, ‘পঁাচ প্রাণ’ ও ‘বিকশিত ভারত’- এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে থেকে যে কোনও একটি বিষয় বেছে নিতে হবে। স্ক্রিপ্ট আসবে ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’ থেকে।
স্ক্রিপ্ট পড়ে বুঝলাম আবার সেই ইতিহাস পুনর্নির্মাণের চেষ্টা। ২৫০০ বছর আগে আমাদের দেশে যখন নাটক হচ্ছে, তখন বিশ্বের বাকি অংশের মানুষ গুহাতে বসবাস করে। শুধু তাই-ই নয়, ভারতবর্ষের অবক্ষয়ের সূত্রপাত চারশো বছর আগে, তার আগে ভারত সোনার দেশ ছিল। এখন আবার সোনার পাখি এই বিকশিত ভারতে ফিরে এসেছে, ভারত এবার বিশ্বগুরু-র আসন নেবে। ইতিহাস, মোদির ভাষণ মিলেমিশে একাকার। ভারতীয় সভ্যতার এক ভুল ইতিহাস নির্মাণ করে ভারতীয় জনতা পার্টি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ দেশকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চাইছে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের বহিরঙ্গে ও অন্তরঙ্গে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে নির্মাণ করছে সংঘ পরিবার।
বাংলা থিয়েটারের ঐতিহ্য ও আদর্শকে স্মরণে রেখে আমার বিশ্বাস ছিল, সেই প্রচারমূলক নাটকটিকে বাংলার নাট্যকর্মীরা বর্জন করবেন, যেখানে কাগজের পাতায় অন্তত তাঁরা দেখে ফেলেছেন এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির মূল স্লোগান ‘বিকশিত ভারত’। কিন্তু না, সেটি ঘটল না, প্রগতিশীল নাট্যকর্মীরা ঝঁাপিয়ে পড়লেন নাটকটি করার জন্য। কারণ মিনিস্ট্রি অফ কালচার একটি সার্কুলারে ‘রেপার্টরি গ্রান্ট’ প্রাপ্ত দলগুলিকে জানাল ‘…All the Grantee Organisations obtaining grant under Scheme of ‘Guru-Shishya Parampara (Repertory Grant)’ are directed to prepare and stage at least one new production in their respective fields i.e. skit/nukkad natak/music/dance/folk etc. of minimum10-20 minutes based on anyone of the above mentioned three themes…’। সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান পাওয়া দলগুলি নাটকটি করতে বাধ্য, না করলে কী হবে তার ভবিষ্যৎ অজানা। আর সেই অজানা আশঙ্কা থেকে তৈরি হল ভয়। বেশিরভাগ নাট্যকর্মী এই ভয়ের কথা জানিয়েছেন, অসহায়তার কথা জানিয়েছেন। এইভাবেই মুক্তচিন্তা আক্রান্ত আজ ভারতবর্ষে। তাহলে আমরা শিল্পীরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাব? নাকি জানাবই না? কোনও প্রশ্ন তুলব, নাকি চুপ করে থাকব?
সম্প্রতি ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন : ‘To question or not to question? That is the question’, ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে গিয়ে যাঁরা স্বাধীন মতামত জানাবেন, যে কোনও বিতর্কিত ভাবনার সঙ্গে নিরন্তর কথোপকথন করবেন এবং স্বশাসিত ব্যক্তিসত্তায় সামাজিক বিচারের দাবিতে সাধারণ মানুষের অধিকারকে সমর্থন করবেন, তাঁরাই ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’। স্বাধীন চিন্তা আর সামাজিক ন্যায়ের পক্ষ সমর্থনের মিশেল সহজ নয় বলেই কি আমরা সৃজনশীল দ্বন্দ্বে ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ হয়ে উঠতে পারলাম না? নাট্যকর্মীরা নিজস্ব মতামত জানাতে কেন ভয় পাচ্ছেন, তার শিকড় কোথায়? একটু উত্তর খোঁজা যাক।
বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী যখন সরকারি ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কোনও মতামত দেওয়ার কথা ভাবেন, তখন স্বকল্পিত এক অজানা ভয় ও তার পরিণামের আশঙ্কায় তাঁরা চুপ করে থাকেন। একে বলা যেতে পারে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’। কেবলমাত্র রাষ্ট্রের অপরিসীম ক্ষমতার কথা ভেবেই চুপ করে থাকেন তা নয়, আসলে আইন আর রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষকে ভয় পাওয়ানোর বা হয়রানি করার দৃষ্টান্তও তো কয়েক দশক ধরে তাঁদের চোখের সামনে আছে। যে কোনও সরকারি ক্ষমতাকে ভয় পাওয়াই এখন ভারতবর্ষের সংস্কৃতি। ফলে বিরুদ্ধাচরণের চাইতে নীরবতাই বিচক্ষণের মতো কাজ বলে বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন এবং অপেক্ষা করে থাকেন প্রতিবাদ করার এক নিরাপদ সময়ের জন্য, যে সময় কখনোই আসবে না। শিল্প রচনার জন্য বেছে নেন নিরাপদ বিষয়, সেটি সমমনস্ক গোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট হলেও ক্রমশ তার স্থান হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। নিজের সঙ্গে নিজের এই প্রতারণা চলতেই থাকে এই আশায় যে, এই আত্মপ্রতারণায় হয়তো কিছুটা হলেও ব্যক্তি মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে। বলাই বাহুল্য, ইতিহাস বলে এমনটি ঘটে না।
বাংলার নাট্যব্যক্তিত্বদের কেউ কেউ হয়তো আত্মপ্রতারণার বিষাদে এই নাটকের ক্ষেত্রে নিজেকে দল থেকে বিযুক্ত করেছেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি, কয়েক দশক ধরে কখন যে নাট্যচর্চায় আদর্শের চাইতে অনুদানের অর্থই প্রাধান্য পেয়েছে, সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। অথবা বলা যেতে পারে বুঝতে চাইনি। আর প্রতিদিনের এই পেশাদারি আপস কখন যে অজান্তে সামাজিক স্তরে ছড়িয়ে যায় আমরা নিজেরাও জানি না। প্রতি বছরের ওই অনুদানের অর্থ তখন ব্যক্তি মানুষের জীবন-যাপনের অঙ্গ হয়ে ওঠে, সবটাই ক্রমশ আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয় এবং তাকেই আমরা বিশ্বাস করতে ভালোবাসি। আমাদের প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে অনিশ্চয়তায় আর কেই বা বাঁচতে চায়? আর অন্যভাবে বাঁচার মধ্যে অনেক উদ্বেগ আছে, উৎকণ্ঠা আছে, না ঘুমোনো রাত আছে, অপমান আছে।
অনেকেই বলেছেন, নাটকটিতে আপত্তিকর কিছু নেই। ক্ষমতা যখন প্রোপাগান্ডার মধ্যে দিয়ে আমাদের কোনও বিষয় সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করতে সক্ষম, তখন এই ধরনের শিল্পীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। যে কোনও ঘটনার সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে গভীর বোধের বদলে ‘কমন সেন্স’ দিয়েই দেখেন এঁরা। ফলে ছোট্ট শিক্ষাঙ্গনের গভীর অনুর্বর মাটিতেই তাঁদের শিল্পের ফসল ফলে, এও এক ধরনের ‘সেলফ সেন্সরশিপ’, যাঁরা কোনও কিছুতেই কোনও আপত্তিকর খুঁজে পান না।
এই বিষয়টি নিয়ে ভবিষ্যতে হয়তো আরও গবেষণামূলক বিশ্লেষণ হবে। হওয়াও উচিত, বাংলা থিয়েটার কোন ফাঁকা আদর্শের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে আর এই শূন্যস্থানে কেন পৌঁছালাম আমরা, তার কারণ হয়তো ভাবীকাল খুঁজবে। আপাতত আমার মনে পড়ছে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘উটপাখী’ কবিতার কিছু অংশ-
‘…ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া।…’
(লেখক নাট্য পরিচালক)