উত্তর সম্পাদকীয়

উত্তরবঙ্গের মুনিয়ারা বাঁচুক নিজেদের ভুবনে

  • দ্যুতিমান ভট্টাচার্য

    গত সেপ্টেম্বরে কোচবিহার জেলায় কাজে যোগদান করি। হাওড়া-কলকাতার ভিড়-ধোঁয়া থেকে আমূল পরিবর্তন। এক বুক সবুজ শ্বাস নিলাম। শহরের রেলগুমটি এলাকায় আমার বাংলো। বাইরে হেরিটেজ তকমা। ভেতরে সবুজের সমাহার।

প্রথম কয়েকদিন খেয়াল করিনি। একদিন হঠাৎ বাংলোর বারান্দায় বসে সকালের চা খেতে খেতে দেখলাম বাগানের রাস্তার দুই ধারে যে দেবদারু গাছগুলো ঝাঁকড়া হয়ে আছে তাতে কয়েকটা ছোট পাখি ঢুকছে বেরোচ্ছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, আরে, ওগুলো তো মুনিয়া!

মুনিয়া আমার খুব প্রিয় পাখি। যখন থেকে পাখির ছবি তোলা শুরু করি, মুনিয়া ছিল অন্যতম প্রিয় মডেল।

উত্তরবঙ্গে মোট ৬ প্রজাতির মুনিয়া রয়েছে। তিলা মুনিয়া, দেশি চাঁদিঠোঁট মুনিয়া, তিনরঙা মুনিয়া, কালো মাথা মুনিয়া, লাল মুনিয়া আর ধলা কোমর মুনিয়া।

তিলা মুনিয়া সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বাদামি রংয়ের ছোট ছটফটে পাখি, ঝাঁক বেঁধে ঘুরতে পছন্দ করে। তবে যখন মন দিয়ে খাবার খায় খুব কাছে যাওয়া যায় এদের। দৈর্ঘ্য কমবেশি ১১ সেমির মতো। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পুরো পিঠ জলপাই-বাদামি। ল্যাজের ওপরে লালচে-কমলা। বুকের ওপরের অংশ তামাটে এবং দেহতল সাদা। পেটে কালো আঁশের মতো তিলা থাকে। পা ও পায়ের পাতা স্লেট রংয়ের। মাদি ও মর্দা পাখির চেহারা একই রকম, তবে মর্দা পাখির দেহতল ও থুতনি মাদি পাখির তুলনায় গাঢ়। অন্যান্য মুনিয়া ও বাবুইয়ের সঙ্গে দলবেঁধে এরা ঝোপ, আখখেত বা ঘাসবনে রাত কাটায়। সচরাচর শ্রুতিকটু স্বরে ডাকে : কিটি-কিটি-কিটি, কিটি-ইইই।

তিলা মুনিয়া ফসলের খেত, মাঠ, নলখাগড়ার বন, বাগান ও ঝোপে ঝাঁকে ঝাঁকে বিচরণ করে। এদের মূল খাদ্য ঘাসের বীজ, কাউন, ধান- এই জাতীয় খাবার। মাটি, ঘাস বা ধানের মধ্যে এরা খাবার খোঁজে। ধান বা অন্যান্য শস্যদানা মুখে রেখেই তা থেকে শক্ত খোসা ছাড়িয়ে নিতে পারে। এছাড়া এরা কীটপতঙ্গও খায়।

মে-সেপ্টেম্বর এদের প্রজননকাল। খেজুর গাছের পাতার আড়ালে, লতার ঝোপে, বাবলা, ঝাউ, দেবদারু বা অন্যান্য ঝোপাকৃতির গাছে ২ থেকে ৫ মিটার উঁচুতে গোলাকৃতির বাসা বোনে। ঘাস-লতা-ধানের পাতা, পালক ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর, নরম ও তুলট বাসার ভিত্তি রচনা করে। কাশফুল দিয়ে চারপাশটা মুড়ে নেয়। বাসার ভেতরে থাকে কাশফুলের গদি। বাসায় ঢোকার জন্য গোপন সরু পথ বানায়, যেন শত্রুরা না দেখে। মাদি মুনিয়া চার থেকে দশটি ধবধবে সাদা ডিম পাড়ে। স্বামী-স্ত্রী মিলে ১৩ থেকে ১৬ দিন তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়।

শহুরে মানুষের কাছে পোষা পাখি হিসেবে তিলা মুনিয়া বেশ জনপ্রিয়। খাঁচাবন্দি মুনিয়া রাস্তাঘাট ও পোষা পশুপাখির দোকানে বিক্রি হয়। ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিক্রেতারা এদের গায়ে নীল, হলুদ, সবুজ রং লাগিয়ে দেয়, যা জলে ধুলেই উঠে যায়। এই পাখি বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এদের অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন। মুনিয়াদের বাঁচতে দিতে হবে তাদের নিজেদের ভুবনে। ওই খোলা আকাশে। ছোট খাঁচায় বন্দি করে নয়। কারণ, পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় এদের অবদান অনস্বীকার্য।

(লেখক কোচবিহারের পুলিশ সুপার)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

উৎসব কই, বড় অসহ্য নির্বাচনের পরিবেশটা

গৌতম সরকার দিন যে আমার কাটে না রে...। কী যে যন্ত্রণা! কোথাও ভোট হয়ে গিয়েছে।…

2 mins ago

যে শালিক মরে যায় কুয়াশায়, সে তো আর…

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য সকালে এক শালিক দেখা মানেই বুক দুরুদুরু! এই রে দিনটা খারাপ হতে চলেছে!…

18 mins ago

আবেগের ভক্তিরস বনাম দারিদ্র্য

রূপায়ণ ভট্টাচার্য মন্দিরের মতো দেখতে রাজকীয় অযোধ্যা রেলস্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে একটি কাঠবেড়ালির…

28 mins ago

Supreme court | উপাচার্য নিয়োগে রাজনীতি বরদাস্ত নয়, বোসকে কড়া বার্তা সুপ্রিম কোর্টের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজনীতি বরদাস্ত নয়। স্পষ্ট জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট।…

45 mins ago

Gang rape case | চলন্ত ট্রেনে গণধর্ষণের শিকার মডেল! প্রায় ২ মাস পর অভিযোগ দায়ের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: চলন্ত ট্রেনে নেশার জিনিস খাইয়ে এক মডেলকে গণধর্ষণের (Gang rape case)…

49 mins ago

Hardik Pandya Banned | মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে দুঃসংবাদ! পরের আইপিএলে দলের প্রথম ম্যাচে নির্বাসিত হার্দিক

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: একে তো ঘরের মাঠে লখনউ সুপার জায়ান্টসের (Lucknow Super Giants) কাছে…

2 hours ago

This website uses cookies.