শিমূল সরকার
টাটা স্টিলটা ছেড়ে দে এবার! শুনে একটু চমকে গেলাম। কালচিনি থেকে আলিপুরদুয়ারে যাচ্ছিলাম বাসে। এখানে সময় ধীরে চলে। ফি ঘণ্টায় বাস আসে। আবার কান পাতি, এখন চেক চলছে মার্কেটে। এখন কিছু ব্লু চিপস কিনে নে! আর কোনও সন্দেহ নেই। শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করে ওই দুজন। রিতু ও ভারতী দুজনেই ফালাকাটায় থাকে। তারা স্নাতক এবং শেয়ারে বিনিয়োগ করে।
একটু পরে পরিচিত মহলে খোঁজ নিয়ে জানলাম শেয়ার বাজার বা অনলাইনে ব্যবসায় বহু নারী-পুরুষ কাজ করছেন। তাঁরা বিনিয়োগ সম্বন্ধে অবহিত। লেখাপড়াও করেন শেয়ার বাজারের বিষয়ে। কেউ কেউ শেয়ার বাজারের জন্য বাগানের চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বসে চুটিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন।
চা বাগান নির্ভর এই অর্থনীতি চলে মহিলাদের উপর। চা বাগানে পাতা তোলার কাজে নারী শক্তির একচেটিয়া অধিকার যেন। চা বাগানে পাতা তোলার কাজে মজুরি ২৫০-৩০০ টাকা। তাঁরা সকাল থেকে ঝুড়ি বেঁধে নেমে পড়েন। তখন বাড়িতে ছোট ছেলেমেয়েদের কে দেখে! মায়া এক হাত পাতা তোলা থামিয়ে বলল, আমার মা আছে। কর্তা? সে বাইরে কাজ করতে গিয়েছে। বছরে একবার আসে পরবের সময়ে। বাকি সময়ে সংসার চলে ফোনের ভরসাতে। উঠে এল করুণ এক কাহিনী। একজনের স্বামী তার ফোন ভুল করে রেললাইন পার হবার সময়ে ধরেছিল। সেই শেষ ফোন ধরা। রেলের লাইনে তাকে পাওয়া যায়।
সেই আক্ষেপ নিয়ে মায়া আজও বাগানে কাজ করে। বাগানে আগের মতো জোর নেই। তাই অনেককে বাগানের সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। তবে তাদের কাছে বিনিয়োগ বা শেয়ারের বাজার ভিনগ্রহের ভাষা। পোস্ট অফিসে জানে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়, কিন্তু একদিনের রোজ ছেড়ে কে যাবে! বাড়িতে এসে করে দিলে করতে পারে। অনলাইন ব্যাংকিংয়ে যাঁরা পর্যটন ব্যবসায় আছেন বেশ সড়োগড়ো। তাঁরা ঝটপট টাকা পাঠিয়ে দেন মোবাইলে।
সমস্যা মাদারিহাটে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের একটা সরকারি কেন্দ্র থাকলে ভালো হত। তাহলে বহু বেকার ছেলে টোটো চালিয়েও দু’পয়সা বিনিয়োগ করতে পারত। তবে সুদে টাকা খাটানো মহাজনদের সেই জাল আজ ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই। কাবুলিওয়ালা জয়গাঁতেও নেই। পর্যটকরা অধিকাংশ ঘর বুকিং করেন অনলাইনে। কম্পিউটার ট্রেনিং না থাকায় স্থানীয় বেকার তরুণরা ঈষৎ চিন্তায়।
তাদের কৃষিপণ্য বিপণনে বড় বাধা এই অনলাইনের উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকা। তবু তারা রিল বানিয়ে আনন্দ উপভোগ করে নিয়মিত। এখন সিনেমা দেখার থেকে রিলের মজা বেশি উপভোগ করে। বৃষ্টিতে নাকাল হয় বারবার। এখন তারা সরাসরি আবহাওয়ার খবর পায়। প্রশাসনের সতর্কবার্তা আসার আগেই হাতের মোবাইলে তথ্য জানার আগ্রহ দক্ষিণবঙ্গের মতো। এই সংযোগ যত মজবুত হবে তত কমবে উত্তর-দক্ষিণের ফারাক।
ছোট করে বললে, প্রযুক্তি ও নেটের ব্যবহার আজ গ্রামীণ বাংলাতে ছড়িয়ে পড়েছে। আগে যাঁরা স্মার্টফোনের ব্যবহারে কুণ্ঠিত ছিলেন, সেই ৪০ অতিরিক্তরাও আজ মোবাইলের মাধ্যমে দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন। পরিযায়ী শ্রমিকরা এই প্রযুক্তির বিষয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে। দরকার নেট নির্ভর ব্যবসার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও টাকার ব্যবহার জানার আগ্রহ।
(লেখক পুলিশ অফিসার)