উত্তর সম্পাদকীয়

লিঙ্গভেদ নিয়ে ছক্কাপাঞ্জার কানাকানি চর্চা শুধু মধ্যবিত্ত সমাজের বিষয়

  • সেবন্তী ঘোষ

বীরভূমে শুটিং চলছে। পরিচালক তপন সিংহের সঙ্গে রয়েছেন লেখক স্বয়ং তারাশঙ্কর। তপন সিংহ লিখছেন, ‘হঠাৎ একজন বৃদ্ধা এসে তাঁকে প্রণাম করল’। হাঁসুলীবাঁকের উপকথা-র গোঁফ কামানো মুখ, মেয়েদের মতো ভঙ্গিতে ছেঁড়া ময়লা শাড়ি পরা, মাথায় খোঁপা বাঁধা, হাতে চুড়ি নোয়া শাঁখা পরা সেই নসুবালা। উপন্যাসে সে করালীর তুতোভাই।
‘কে রে নসু নাকি… আয় আয়। সাদরে আহ্বান জানালেন তারাশঙ্কর।’

‘হ্যাঁ বাবু, ভালো আছেন তো?’ বৃদ্ধাটি বলল। কিন্তু গলার আওয়াজ শুনে কেমন যেন মনে হল। তারাশঙ্কর তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, ‘এ হচ্ছে হাঁসুলীবাঁকের উপকথার নসুবালা।’ এবার ভালো করে দেখলেন যাকে বৃদ্ধা ভেবেছিলেন সে আসলে একজন পুরুষ। নসু জন্মশরীরে পুরুষ, অথচ আদতে নারী।

উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯৪৭। লিঙ্গ-যৌনতার পাঠের শব্দগুলির জন্মই হয়নি। তারাশঙ্কর তাঁকে সামান্যও বদলাননি, যেমন ছিল তেমন দেখিয়েছেন। দিন গড়িয়েছে। এই নসুবালারা নানা চরিত্র হয়ে বাংলা সাহিত্যে মাঝেমধ্যেই এসেছে। কমল চক্রবর্তীর ‘ব্রহ্মভার্গব পুরাণ’ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। সেখানে প্রার্থনা ছিল, ‘জগন্নাথ হে আর জন্মে ছ্যাইলা কইর হে/ জগন্নাথ হে আর জন্মে মাইয়া কইর হে/ এ জন্মে সকল নিলে সিপাই দিলে মাঝখানে/ জগন্নাথ হে আর জন্মে ছ্যাইলা কইর হে…’। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘হলদে গোলাপ’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পরিমল, দুলালী। কাহিনী বয়ানে মানুষের লিঙ্গ পরিচয়ের সমস্যা তুলে আনতে গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে লেখক তুলে এনেছেন ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, শারীরবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, পুরাণ। উপন্যাসের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে তৃতীয় লিঙ্গ। এ তো গেল লেখা ও লেখকের গল্প। এবারে আসি ব্যক্তিগত কথায়।

চুরানব্বই পঁচানব্বই সাল। থাকি কলকাতা বিমানবন্দরের পিছনে কলোনি এলাকায় সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় মটর নামী এক নারী আসতেন। সবসময় সাফারি সুট। শরীর নারীর হলেও আদতে পুরুষ। সঙ্গের পুরুষ বন্ধুদের মতোই তাঁর আচরণ। অবাক হয়ে দেখলাম, স্বল্পশিক্ষিত ওই কলোনি এলাকার সমাজের নীচুতলার পেশায থাকা মানুষ মটর নারী না পুরুষ, এই নিযে ভাবিতই নয়। সম্যক উপলব্ধি করেছিলাম, এই লিঙ্গভেদ, কৌতূহল এবং তা নিয়ে ছক্কাপাঞ্জার কানাকানি চর্চা একেবারে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের বিষয়।

ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা কিছু প্রাচীন ধ্যানধারণা বদলে দিয়েছিল ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের দুটি ঐতিহাসিক রায়। ২০১৪ সালের পযলা বৈশাখ সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, রূপান্তরকামীদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। সেই রায়ে বিচারপতি কেএস রাধাকৃষ্ণন জানিয়েছিলেন, রূপান্তরকামীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে, ফলে শিক্ষা, জীবিকা ও নানা খাতে সরকার যেন এঁদের সমান সুযোগের বন্দোবস্ত করে। তৃতীয লিঙ্গের স্বীকৃতি কোনও সামাজিক বা চিকিৎসা সংক্রান্ত ইস্যু নয়, মানবাধিকারের প্রশ্ন। ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ ঘোষণা করে সমকাম যৌনতা আর অপরাধ নয়, বরং মানুষের মৌলিক অধিকার।

ক’দিন আগে শিলিগুড়িতে হয়ে গেল কুয়্যর ফেস্টিভাল। গত কয়েক বছর এখানে প্রাইড ওয়াকে উপস্থিত থেকেছি। বড় শহরে থাকা রূপান্তরকামী মানুষ, যাঁরা এখন সমাজের প্রধান পেশার কাজগুলিতে যুক্ত, তাঁরা এই অনুষ্ঠানে এসে আপ্লুত ও বিস্মিত হয়ে যান। এবছরও ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী নারী বিচারক জয়িতা মণ্ডল শিলিগুড়ির অনুষ্ঠানটিতে এসে বিস্মিত। বললেন, ‘মনে হচ্ছে না, এটি উত্তরবঙ্গের কোনও শহরের আয়োজন। ভারতের কোনও বড় শহরেই আছি মনে হচ্ছে, যেখানে বহু সংখ্যকের মধ্যে এই চেতনা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত।’

কোভিড পর্বের আগে যখন আমার ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা পরিচালিত এই অনুষ্ঠানে প্রথমবার উপস্থিত হই, যখন তারা শহরের পথে বেরোয়, চারদিকে চকচকে চোখের কৌতূহল দেখেছিলাম। বাক্যবাণ, গালিগালাজ শুনেছিলাম। তাদের সেই ব্যঙ্গ স্বরকে আরও উচ্চৈঃস্বরে, আরও চড়া সুরে ঢেকে দিয়েছিল অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা। পরে ভেবেছি আমাদের সহানুভূতিহীনতা, কূট ব্যঙ্গোক্তি আসলে ওদের আগ্রাসী করে তোলে। পরস্পরের ভাষা বুঝতে হলে প্রথমেই নাকচ করে দেওয়া এবং আক্রমণাত্মক মনোভাব মন থেকে পরিত্যাগ না করলে কোনওদিনই পাশাপাশি আসা সম্ভব নয়।

একজন বললেন, ‘আপনারা বলেন আমাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার দরকার। কিন্তু বলুন তো, পরিবার, আত্মীয়, সহপাঠী, কোন বিদ্যালয়, কোন শিক্ষকরা মন থেকে আমাদের গ্রহণ করেন? নিজেকে বুঝতে শেখার পর আমাদের পরিবারের ভিতরে লড়াই শুরু হয়। প্রথমে পরিবার বিষয়টি অস্বীকার করে। তারপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার, ব্ল্যাকমেল। সব জেনেবুঝে সমাজের চোখে ঠিক থাকার জন্য একটি সামাজিক বিবাহ দেওয়া হয়।’ বিদ্যালযে একটি শিশুর যেখানে নিজেকে বুঝতে সমস্যা হচ্ছে, চারপাশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না, সেখানে সবচেযে আগে থাকা দরকার শিক্ষকদের। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় এখনও আমরা এমন একভাগও শিক্ষক দেখতে পাই না। একটু আড়াল হলেই তাঁরা অন্যরকম শিশুকে নিয়ে চর্চা করেন। প্রশ্ন ওঠে কত। কেন রূপান্তরকামীরা বাড়ি ভাড়া পেতে সমস্যার সম্মুখীন হন? তৃতীয় লিঙ্গের জন্য পাবলিক টয়লেট কেন হবে না? কেন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হবে না ‘কুয়্যর স্টাডিজ?’

শিলিগুড়ি প্রাইড ওয়াক ও সারাদিন ধরে চলা আলোচনা, গান, নাচ, কবিতা-সংলাপ বিনিময়ে যে রঙিন উচ্চারণ উঠে আসে, তার প্রধান উদ্যোক্তা বোধিসত্ত্ব। পেশায় আইন ব্যবসায়ী। রূপান্তরকামীদের নানা আইনি কাগজ তৈরিতে সাহায্য করেন। যেমন টিজি কার্ড ইস্যু, যাতে ডিএমের অনুমতির প্রযোজন। এই কার্ডের মাধ্যমেই আধার কার্ড ইত্যাদি প্রমাণপত্রে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে তাঁরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন কোথাও স্কুল-কলেজে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না, চাকরির ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে, তরুণ বোধিসত্ত্ব সেখানে আইনের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, শরীর বদল না করলে প্রশাসন কি প্রশ্ন করতে পারে তিনি আদৌ রূপান্তরকামী কি না। জানা গেল, সুপ্রিম কোর্টের নালসা আইনে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, কোনও সার্জারির প্রমাণের প্রয়োজন নেই।

আলোচনায় প্রবীরের কথা শোনা গেল। উত্তরের ফাল্গুন সংস্থার কর্ণধার প্রবীর তুলনায় বয়স্ক। তাঁদের সময় পথ ছিল আরও কঠিন। সমাজ ছিল আরও কঠোর। চারপাশে বহুজনকে আত্মহত্যা করতে দেখেছেন। গভীর বিষাদে চলে যেতে দেখেছেন। এভাবেই সবার কথা ভেবে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে এসেছিলেন। দার্জিলিং জেলার ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডে আছেন। যদিও শোনা গেল, এই ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডটি আদতে শিশু ও নারীকল্যাণ দপ্তরের অধীন। স্বতন্ত্র একটা দপ্তরের ন্যায্য দাবির কথা উঠল। সংসদীয় রাজনীতিতে যদি কোনও সংরক্ষণ রাখা যায়, তাদের সামাজিক উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। কারণ স্বীকার করি আর না করি, একটি কুঁচো নেতার ক্ষমতা যে কোনও সম্মাননীয় নাগরিকের থেকে ঢের বেশি।

সিকিমের রেইনবো হিলস অ্যসোসিয়েশনের বিশাল রাই বলছিলেন, তাঁর কাজের কথা। কাজ রূপান্তরকামীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং অসুস্থতা দূরীকরণ। তার মধ্যে অবশ্যই এইচআইভি আক্রান্তদের বিষয়টি আছে।

একসময় সারা ভারতকে নড়িয়ে দেওয়ার মতো আন্দোলনের জন্মস্থান এই শিলিগুড়ি সংলগ্ন উত্তরবঙ্গ। উত্তর অবহেলিত হলেও তাকে অস্বীকার করা যায় না। উত্তরের এই ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে একজোট হয়ে এই কাজ করতে পারছে, আমাদের তরফে ওদের কথাগুলো ধৈর্যের সঙ্গে শোনা দরকার। শুধু বিশেষ অনুষ্ঠানে নাচ, গান, নাটক নয়, সমাজের মূলস্রোতের নাটকের ফেস্টিভাল বা সংগীত নৃত্যানুষ্ঠানে দলবেঁধে অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

কেন্দ্রীয় সাহিত্য আকাদেমি এই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। গতবছর সিমলা এবং এ বছরে ভোপালে অনুষ্ঠিত সাহিত্যসংস্কৃতির অনুষ্ঠানে বিরাট সংখ্যক রূপান্তরকামী শিল্পীদের উপস্থিতি ছিল। তাই আমরা ছোট ছোট শহরে কবিতার অনুষ্ঠান থেকে নৃত্যানুষ্ঠান, সব জায়গায় তাঁদের উপস্থিতি চাইতেই পারি। মেল গেজ আর পৌরুষের ধ্বজা যখন পতপত করে জাতীয় সংগীত ছুঁয়ে ফেলেছে, তখন আশাহীনতার বদলে চোরাগোপ্তা গেরিলা আক্রমণে কাজ হাসিল করতে হয়। একটু একটু করে পরিবর্তন আসছেও। আজ যখন সুইগি বা উবর প্রাইডের মাসে লোগো রামধনু করে দিচ্ছে, সেটা প্রচুর সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। তাদের ব্যবসা কৌশল হলেও এর ভালো দিক স্বীকার করতে হবে। আইন সবচেয়ে বড় হাতিযার। সচেতনতা তেমনই আরেকটি। নতুন বছরের প্রাক্কালে অল্পবয়সিদের দেখতে দেখতে গর্বে বুক ভরে যায়, যখন দেখি কেউ কেউ নিজেরা রূপান্তরকামী না হয়ে ভালোবাসায়, বন্ধুদের পাশে থাকার আকুলতায় প্রতিনিয়ত শামিল হচ্ছে, তখন মনে হয় এরাই আমাদের ভবিষ্যতের আশা।

                                   (লেখক সাহিত্যিক ও শিক্ষক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Bride torture | কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়াই অপরাধ! স্ত্রীকে মেরে বাড়ি থেকে তাড়ালেন স্বামী

রায়গঞ্জঃ অপরাধ, কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়া। তাই সব সময়ই রাগ সপ্তমে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের।…

5 mins ago

Balurghat | তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানের শাস্তি! স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য মিলছে না শংসাপত্র

বালুরঘাট: তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন, এটাই ছিল অপরাধ। তাই ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত স্ত্রীর চিকিৎসার…

9 mins ago

Sand Mafia | বালি পাচার রুখতে গিয়ে মাথা ফাটল সরকারি কর্তার, গ্রেপ্তার ২

করণদিঘিঃ বালি পাচার রুখতে গিয়ে মাথা ফাটল ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের কর্তার। আক্রান্ত এই…

22 mins ago

Sand Smuggling | বালিপাচারে যোগ, আর্থমুভারের মালিককে এক লক্ষ টাকা জরিমানা

কুশমণ্ডি: এখনও লোকসভা ভোটের তিনটি দফা বাকি। তার মধ্যেই বালিপাচারের সঙ্গে নাম জড়াল তৃণমূল নেতার।…

23 mins ago

lightning | ফুটবল খেলার সময় বজ্রপাতে মৃত্যু কিশোরের, আহত ৯

হরিরামপুর: ফুটবল খেলার সময় বজ্রপাতে মৃত্যু হল এক কিশোরের। মৃত কিশোরের নাম জয়ন্ত বেসোয়ার(১৫)। বাড়ি…

40 mins ago

S Jaishankar | ‘সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়ুন’, চাবাহার নিয়ে আমেরিকার ‘নিষেধাজ্ঞা’র কড়া জবাব জয়শংকরের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে সকলের সুবিধার কথা ভাবতে হবে। এবার নাম…

52 mins ago

This website uses cookies.