Tuesday, June 18, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়ক্ষুধার দেশে বক্তৃতা কাব্যময়

ক্ষুধার দেশে বক্তৃতা কাব্যময়

বিশ্বের ক্ষুধার সূচকে ভারত ১২৫ দেশের মধ্যে ১১১। প্রতিবেশীরা ভারতের থেকে এগিয়ে। অথচ সব দল নিরুত্তাপ।

রূপায়ণ ভট্টাচার্য

সন্ধের দিকে শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মাঝে মাঝেই নাকে লাগে টাটকা রুটির গন্ধ। ও হো, বাতাসে গরম রুটির বাস খুব মন ছোঁয়া। সংক্রামক। একান্ত নিজের মনে হয়।

অজস্র মহিলা সেসময় রুটি বানান কলকাতার অধিকাংশ রাজপথে। গভীর রাত পর্যন্ত। তাওয়ার উপরে রুটি ফুলে ওঠার দৃশ্য অনেকটা ফুল ফোটার মতো। কারও পাশে তখন স্বামী, কারও পাশে সন্তান। এই জাতীয় ছবি ইদানীং উত্তরবঙ্গের নানা শহরে সংক্রামিত। বহু বাড়িতে আর রাতে রুটি হয় না। তরকারি বানানো হল হয়তো। আন তো রে তা হলে গোটা চারেক রুটি কিনে!

বাংলাদেশের কাগজে পড়লাম, বৃহস্পতিবার তাদের খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে বলেছেন, ‘এখন দেশে গরিবেরা তিনবেলা ভাত খায়, ধনীরা খায় আটার রুটি।’

নওগাঁর সাধন পাঁচ বছর ধরে পদ্মাপারের খাদ্যমন্ত্রী। একেবারে কৃষকের ছেলে। নিজে চাষ করেছেন, আড়তে ধান-চালের ব্যবসা করতেন একদা। তাঁর পর্যবেক্ষণ ফেলে দেওয়া যাবে না কিছুতেই।

বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী ঠিক কী বলেছেন, তা বোঝাতে তাঁর সংলাপের পুরোটা তুলে দিই। ‘আগে গরিবেরা আটার রুটি খেত। সেই সময় কেউ আটা কিনলে মনে করা হত, তিনি সবচেয়ে গরিব। এখন গরিবেরা তিনবেলা ভাত খায় আর যারা ধনী, তারাই আটার রুটি খায়। সেটা ওজন বাড়ার ভয়ে হোক কিংবা ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণের জন্যই হোক।’

বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রীর পরবর্তী পর্যবেক্ষণ সমান চাঞ্চল্যকর। ‘একসময় আমাদের খাদ্যের অভাব ছিল। অনেকেই তখন একবেলা ভাত খেতেন। বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে খেতে হত। এখন আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্যের অভাবে কোনও মানুষ মারা গিয়েছে, এমন ইতিহাস বাংলাদেশে নেই। শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ।’

এই জায়গায় মেলানো যেতে পারে, ওপার বাংলার সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের মিল কি আগের মতো রয়েছে, না সম্প্রতি পালটেছে কিছুটা? সাধনবাবুর কথা মানলে গরিবেরা ওদেশে তিনবেলা ভাতই খান, রুটি নয়। এপারের ছবিটা বোধহয় তা নয়। সম্প্রতি দেশজুড়ে মিলেট জাতীয় খাবারের চাহিদা। উত্তরবঙ্গেই অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছে ভুট্টাখেত। আগে যে বাঙালি মাত্রেই ভাত পাগল ছিল, দু’বেলা ভাত স্বাভাবিক ছিল, এখন তা নেই। কলকাতা এবং শিলিগুড়ির অনেক পাইস হোটেলের মালিকের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, অনেক মানুষ নিয়মিত রুটি খেতে আসেন। ভাতের পাশাপাশি রুটিও বানাতে হয় অনেককে। মাছের সঙ্গে হয়তো ভাতই বাধ্যতামূলক থাকে, মাংসের সঙ্গে রুটির বেশি চাহিদা। এটা সব জায়গার নয়া প্রবণতা।

বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রীর ‘ক্ষুধামুক্ত’ মন্তব্যে আমাদের ভারতীয়রা কোনও কটাক্ষ করার জায়গা নেই। বিশ্বের হাঙ্গার ইনডেক্সে ১২৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৮১ নম্বরে, আমরা বহু পিছনে- ১১১।

কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিবার এই ইনডেক্সকে নাকচ করে ভুল পদ্ধতি বলে। অথচ এই পরিসংখ্যানই বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সমাদৃত। খিদের বিচারে দেশগুলোকে পাঁচটি ভাগে রাখা হয়। এক নম্বরে যে দেশে ক্ষুধার্ত কম। দুইয়ে ক্ষুধার্তের সংখ্যা মাঝামাঝি। তিনে সমস্যা গভীর। চারে বিপজ্জনক। পাঁচে ভয়ংকর বিপজ্জনক। আমরা রয়েছি তিন নম্বরে। আমাদের সমস্যা গভীর। আমাদের সব প্রতিবেশী তুলনায় অনেক ভালো জায়গায়। শ্রীলঙ্কা (৬০), নেপাল (৬৯), পাকিস্তান (১০২) এই শতাব্দীতে ২৩ বছরে আমরা দুর্বলতা কমাতে পেরেছি অনেক কম। আরও তাৎপর্যপূর্ণ, গত এক বছর ভারত-পাক তালিকায় নেমেছে, বাকি তিনটি দেশ এগিয়েছে।

ভারতীয়রা হয়ে আছি সেই ছাত্র, যে বারবার ভুল ধরিয়ে দিলেও ঠিক কাজটা করতে পারে না। ২০০০ সালের ৩৮.৮ থেকে ২০২২ সালে ২৯.১। গতবার আমরা ছিলাম ১২১ দেশে ১০৭, এবার ১২৫-এ ১১১। বিস্ময়ের বিস্ময়, এতদিন ধরে নির্বাচন হল, কোনও পার্টিই এই ব্যাপারে জোর দিল না। মনে করতে পারছি না, সূচকে অবনমন নিয়ে কোনও বিরোধী দল কোনও ভাষণে সোচ্চার হয়েছে কি না।

বাংলাদেশের কৃষক খাদ্যমন্ত্রীর আরও কিছু কথা শোনাতেই হবে। জানি না আমাদের দেশের নতুন খাদ্যমন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী চিরাগ পাসোয়ান ভাত এবং চাল নিয়ে এতশত জানেন কি না। আমাদের এই বাংলার খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষ, কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ও কি জানেন? ঢাকার কাগজ প্রথম আলোকে পদ্মাপারের খাদ্যমন্ত্রী শুনিয়েছেন, ‘এখন আমরা পাঁচ ছাঁটাই দেওয়ার পর চাল চকচকে করে খাই। সেখানে চালে শুধু কার্বোহাইড্রেট ছাড়া কিছুই থাকে না। সেই কারণে পুষ্টিগুণ সংমিশ্রণ করে আমাদের বিতরণ করতে হচ্ছে। এতে অবশ্য ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বেড়েছে।’ পরবর্তী সংযোজন, ‘পাঁচটা ছাঁটাই করে চকচকে বানানোর জন্য কিন্তু শুধু ছাঁটাইয়ে হয় না। পিচ্ছিল করতে স্যালাইন ওয়াটার ড্রপ বাই ড্রপ দিতে হয়। আর না হলে ইউরিয়া সার গুলিয়ে স্যালাইন ওয়াটারের ব্যাগের ভেতরে এক ফোঁটা দিয়ে পানি শুকানো সেই চাল আমরা খাচ্ছি। এই ছাঁটাই চাল বন্ধ করতে চাই।’

বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রীর পরবর্তী বিশ্লেষণ, ‘আমরা আগে এক ছাঁটাইয়ের চাল খেতাম। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এক ছাঁটাই বা দুই ছাঁটাইয়ের বেশি চাল ছাঁটাই করা যাবে না, তাতে পুষ্টিগুণ ঠিক থাকে। এই চিন্তাভাবনায় আমরা আছি। সেভাবে আমাদের আইনও তৈরি করা হয়েছে, বিধিমালা হচ্ছে, এখন নীতিমালা ছড়িয়ে দেব। জুলাইয়ে সব মিল মালিককে ডেকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।’

এইভাবে কি আমাদের দেশে বা রাজ্যেও কাজ হয়?

জিএইচআই যেমন সব দেশের ক্ষুধাসূচক জানিয়ে দেয়, ঠিক এভাবে দেশের রাজ্য পর্যায়ের ক্ষুধা সূচক তৈরি করেছে একটি সংস্থা। সূচকের নাম এসএইচআই- স্টেট হাঙ্গার ইনডেক্স। ২০১৯-’২০ সালে এমনই এক সূচক বানাতে চারটি প্যারামিটার ছিল। শূন্য থেকে ১০০-র মধ্যে স্কোর দেওয়া হয় রাজ্যগুলোকে। যার যত বেশি স্কোর, সেখানে তত বেশি ক্ষুধার্ত মানুষ। শূন্য থেকে ১০-এর মধ্যে থাকলে কম ক্ষুধার্ত, ১০ থেকে ২০ হলে মাঝামাঝি, ২০ থেকে ৩০ হলে সিরিয়াস, ৩০ থেকে ৪০ হলে বিপজ্জনক, ৫০-এর ওপরে থাকলে ভয়ংকর বিপজ্জনক।

সেই সমীক্ষায় দেখা যায়, সবচেয়ে দুর্দশা বিহার, ছত্তিশগড় এবং ঝাড়খণ্ডের। তিন রাজ্যের স্কোর ৩৫.৫। তারপর অবিশ্বাস্যভাবে প্রধানমন্ত্রীর দুটি প্রাণের রাজ্য গুজরাট ও উত্তরপ্রদেশ। দুই রাজ্যেরই স্কোর ৩৩.৫। এদের পর বর্তমানে বিজেপি শাসিত সব রাজ্য- অসম, ওডিশা, মধ্যপ্রদেশ ও ত্রিপুরা। পশ্চিমবঙ্গেরও উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা নীচের দিক থেকে বারো নম্বরে। আমাদের স্কোর ২৯.৪। ভারতের সামগ্রিক স্কোরের (২৯.৭) ঠিক নীচেই।

জানতে চাইতে পারেন, ভদ্রস্থ জায়গায় তা হলে কোন রাজ্য? সমীক্ষায় দেখছি, প্রথম পাঁচে চণ্ডীগড়, সিকিম, পণ্ডিচেরি, কেরল ও মণিপুর। বলতে পারেন, ছোট ছোট রাজ্যে এই ধরনের সমস্যা কম। সেখানে বলে রাখা ভালো, তামিলনাডু ও পঞ্জাব কিন্তু ভালো স্কোর করে রয়েছে প্রথম দিকে। মানুষের ক্ষুধা মেটানোর জন্য সরকার কি কিছু করেছে আদৌ?

আমাদের শৈশবে প্রতি রবিবার গ্রাম হোক বা শহর, প্রতি বাড়িতে থালাবাটি নিয়ে হাজির হত ভিক্ষুকের দল। মা, ভিক্ষে দাও মা- সেই আর্তি এখনও কানে লেগে আছে। এখন সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না মানেই যে ভিক্ষুক কমে গিয়েছে, তা তো নয়। শহরের সব বড় মন্দির-মসজিদের পাশে যেসব অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ভাত বা রুটির প্রার্থনায় বসে থাকেন, তাঁদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান আমরা করিনি। শহর শিলিগুড়ির আনন্দময়ী বা মায়ের ইচ্ছে কালীবাড়ি, কোচবিহারের মদনমোহন মন্দিরের সামনে যাঁরা ভিক্ষে করেন, প্রশাসন কি তাঁদের জন্য ভেবেছে কিছু?

আমাদের ক্ষুধার দেশে বক্তৃতা কাব্যময় হয়ে পড়ে থাকে। নেতাদের বক্তৃতাই বেশি হয়, মানুষের খিদে মেটে না। দিনকয়েক আগে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী মুখের বহুচর্চিত নির্বাচনি কেন্দ্র ঘুরেও দেখি, সেই এক ছবি। নরেন্দ্র মোদির বারাণসীর রেলস্টেশনে বা গঙ্গার ঘাটে ঘাটে এখনও বহু অসহায় বসে থাকেন। ভিক্ষেই তাঁদের খিদে মেটানোর একমাত্র পথ। কেউ জানে না, তাঁদের নিয়ে কোনও মস্তান ব্যবসা করে কি না। হয়তো অর্ধেক প্রাপ্তিই তুলে দিতে হয় স্থানীয় দাদাদের হাতে। রাহুল গান্ধির রায়বরেলির রেলস্টেশন তুলনায় অনেক নির্জন। ভুলতে পারি না সেখানে সহায়হীন, নিঃসঙ্গ অসুস্থ বৃদ্ধার সবার কাছে ঘুরে ঘুরে হাত পাতা। কয়েক প্যাকেট বিস্কুট ও ঠান্ডা পানীয় পেতেই তাঁর মুখ স্বর্গীয় হাসিতে ভরে যায়। কিন্তু সে তো কিছুক্ষণের জন্য। একদিন হল। তারপর?

সব ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে এমন স্বর্গীয় হাসি আমরা দেখতে পাব কবে? যে হাসি সারাদিন জেগে থাকবে হৃদয়ে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Bomb Threat | পাটনা বিমানবন্দরে বোমা হামলার হুমকি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: পাটনার জয়প্রকাশ নারায়ণ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (Patna Airport) বোমা হামলার হুমকি। ইমেলের মাধ্যমে বোমা হামলার হুমকি (Bomb Threat) দেওয়া হয়েছে বলে...

Train Accident | সিগন্যাল ভাঙার অনুমতি দিয়েও কেন মালগাড়ির চালক-সহচালকের বিরুদ্ধে এফআইআর? প্রশ্নের মুখে...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: কাঞ্চনজঙ্ঘা বিপর্যয়ে (Train Accident) মালগাড়ির চালক ও সহকারি চালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে নিউ জলপাইগুড়ি জিআরপিতে। এক যাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে...

Train accident | বৃষ্টি পড়ায় বাতানুকূল কামরায় উঠেই প্রাণরক্ষা! দুর্ঘটনার কথা ভেবেই শিউরে উঠছেন...

0
গাজোল: অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল বলে অভিশপ্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের (Kanchanjungha Express) জেনারেল কামরায় উঠতে পারেননি। উঠে পড়েছিলেন এসি কামরায়। তার জন্যই হয়তো বরাতজোরে প্রাণে...

Lightning | বজ্রপাতে মৃত্যু যুবকের

0
চোপড়া: বজ্রপাতে মৃত্যু হল এক যুবকের। মঙ্গলবার চোপড়া থানার আমবাড়ি-লোধাবাড়ি এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে। এ ঘটনায় আরও কয়েকজন জখম হয়েছেন। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃতের...

Putin to visit north korea | অস্ত্র চুক্তি! ২৪ বছর পর কিমের দেশে পুতিন

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে উত্তর কোরিয়া যাচ্ছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (Putin to visit north korea)। দীর্ঘ ২৪ বছর পর ‘বন্ধু’...

Most Popular