উত্তর সম্পাদকীয়

‘দেশি’ বিয়ের অর্থনীতি: লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা আঁকড়ে ধরার অপেক্ষায়

  • অতনু বিশ্বাস

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি একটা ডাক দিয়েছেন, ‘ওয়েড ইন ইন্ডিয়া’। অর্থাৎ ভারতে বিয়ে করার আহ্বান। এটা কিন্তু সবিশেষ উল্লেখযোগ্য এবং অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এ যেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ধরনের একটা আন্দোলনের ডাক। যদিও এটা বাস্তবায়িত করা খানিকটা হলেও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-কে বাস্তবায়িত করার তুলনায় অনেকটাই সহজ কাজ।

প্রধানমন্ত্রী দেশের মাটিতে বিয়ে করতে বলছেন কেন, সেটা বোঝা কিন্তু খুব একটা কঠিন নয়। বিয়ের তো একটা অর্থনীতি আছে। বিয়েতে প্রচুর খরচ করা হয়। সাধারণ মানুষের বিয়েতে তাঁদের সংগতি অনুসারে খরচ হয়। ধনীদের বা অতি ধনীদের সংগতি অনেক বেশি, যার ফলে তাঁরা খরচ করেন প্রচুর। এমনকি এসবের ফলে হয় প্রচুর পরিমাণে কর্মসংস্থানও। ঠিক কতটা বড় যে এই অর্থনীতির পরিমাণ, সেটা কিন্তু সাধারণভাবে বোঝাও কঠিন।

প্রথমেই বোঝা দরকার, প্রধানমন্ত্রীর এই ডাকটা অবশ্যই আমআদমির উদ্দেশে নয়। আমআদমির বিয়েতেও তাঁদের সাধ্যমতো খরচ হয় এবং সেসবের মিলিত প্রভাবও অর্থনীতিতে যথেষ্ট। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো আর বিদেশে গিয়ে বিলাসবহুল বিয়ের অনুষ্ঠান করতে পারবেন না। সেটা পারেন এবং করে থাকেন ধনীরা। ব্যবসায়ী পরিবারগুলো বা রুপোলি পর্দা কিংবা খেলার দুনিয়ার ধনী তারকাদের বিয়ে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত হলে তা কিন্তু নিয়ে আসতে পারে অর্থনীতিতে জোয়ার। কতটা? অনুষ্কা শর্মা আর বিরাট কোহলি ইতালিতে বিয়ে করছেন, তেমনটাই করছেন দীপিকা-রণবীর। মিডিয়ার খবর অনুসারে অনুষ্কা-বিরাটের বিয়েতে নাকি খরচ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। দীপিকা-রণবীরের বিয়েতে খরচ হয়েছে ৭৭ থেকে ৭৯ কোটি টাকার মধ্যে। এই ধরনের বিয়েগুলো দেশের কোনও বিলাসবহুল প্রাসাদ কিংবা রিসর্টে হলে বছরে মোট এক লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত যুক্ত হতে পারে দেশের অর্থনীতিতে, যে টাকাটা বিদেশে চলে যাচ্ছে প্রতি বছর ধনীদের বিয়ের অনুষ্ঠানের ফলে।

প্রধানমন্ত্রী এই আহ্বানটা জানিয়েছেন সাম্প্রতিক উত্তরাখণ্ড গ্লোবাল ইনভেস্টর সামিটে। তিনি বলেছেন, উত্তরাখণ্ডে আগামী পাঁচ বছরে ৫,০০০ ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের বিয়ে অনুষ্ঠিত হলেই রাজ্যটা হয়ে উঠতে পারে ‘ডেস্টিনেশন ওয়েডিং’। তৈরি হয়ে যাবে প্রযোজনীয় পরিকাঠামোও। কিন্তু শুধু উত্তরাখণ্ডই বা কেন, এই ‘ডেস্টিনেশন ওয়েডিং’ তৈরি হতে পারে এবং উপকৃত হতে পারে রাজস্থান, কেরল, মধ্যপ্রদেশ, গোয়া, … কোথায় নয়। এই আইডিয়াটা নিশ্চয়ই হঠাৎ আসেনি, এর আগে ২৬ নভেম্বরের ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানেও এই ডাক দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

ধনীদের জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে কিন্তু অর্থনীতিতে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র ভারতেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই। অর্থনীতিতে বিয়ে বাজারের দাম ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন টাকা। যদিও এই বাজারের পুরোটা যে খুব সংগঠিত এবং সুসংবদ্ধ, তেমনটা নয়। এর কিন্তু নানা অংশ। উপহার, আমন্ত্রণ, বিবাহস্থল, তার খাবারদাবার এবং মণ্ডপসজ্জা, ইভেন্ট পরিকল্পনা, রসদ, ছবি এবং ভিডিও তোলা, সাজসজ্জা ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধুমাত্র বিয়ের পোশাক, বিয়েতে যোগ দেবার জন্য যাতায়াত, হোটেল বুকিং এবং বিয়ের গয়নাতেই প্রতি বছর খরচ হয় বিপুল পরিমাণে। এর সঙ্গে রয়েছে প্রাক বিবাহ উদযাপন এবং হানিমুনের জন্য খরচ, যেসবও কিন্তু বিয়ের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা। কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্সের হিসেবে বছরে এদেশে এখন বিয়ে মোটামুটি ৩৮ লক্ষ এবং সেই বিয়ের জন্য বিবিধ পরিষেবা মিলে খুচরো খাতে নাকি ব্যবসা ৪.৭৪ লক্ষ কোটি টাকার।

ধনীরা যে বিয়ে করতে বিদেশে যান তার ফলে অনেকটাই উপকৃত হয় সেসব দেশের অর্থনীতি। ইতালি অবশ্যই ভারতীয় ধনীদের বিয়ের জন্য একটা পছন্দের জায়গা। কিন্তু মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, তুরস্কও বেশ উপকৃত হচ্ছে ভারতীয় ধনীদের বিয়ের ফলশ্রুতিতে।

এসব বিয়ের অনুষ্ঠানের একটা বড় অংশ কি এবার থেকে ভারতেই হবে তাহলে? এইসব ‘বিদেশি’ বিয়েগুলি কি এবার থেকে হয়ে যাবে পুরোদস্তুর ‘দেশি’? রানি মুখার্জি-আদিত্য চোপড়া কিংবা প্রিয়া রাঞ্চাল-জন আব্রাহামের মতো বিয়ের অনুষ্ঠান কি এবার থেকে নিয়ম করে ভারতেই হতে থাকবে? ফলশ্রুতিতে খানিকটা হলেও কি পুষ্ট হবে ভারতের অর্থনীতি?

তাহলে দিগন্তটাকে আরেকটু বিস্তৃত করতে ক্ষতি কি? কেমন হয় এই ‘ওয়েড ইন ইন্ডিয়া’র প্রচারটাকে ভারতের ট্যুরিজমের প্রচারের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে বিদেশিদের ভারতে এসে বিয়ে করতে উৎসাহিত করতে পারলে? কেমন হয় একটা আবিশ্ব ‘ওয়েড ইন ইন্ডিয়া’ প্রচারের ফলে যদি আরও বেশি করে এলিজাবেথ হার্লি-অরুণ নায়ার কিংবা প্রিয়াংকা চোপড়া-নিক জোনাসের মতো বিয়ের অনুষ্ঠান আরও বেশি করে হতে থাকে আগ্রায়, রাজস্থানে কিংবা পশ্চিমবঙ্গে? এর ফলে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিতে একটা উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তেই পারে।

এই দুটি উদাহরণের ক্ষেত্রেই জুটির একজনের অন্তত ভারতের সঙ্গে একটা গাঢ় সম্পর্ক ছিল। তাই ভারতে বিয়ে হওয়াটা অনেকটা সহজ সমীকরণ এই ক্ষেত্রগুলিতে। কিন্তু আমরা হয়তো দিগন্তটা আরও বিস্তৃত করার কথা ভাবতে পারি। ভাবতে পারি কেটি পেরি আর রাসেল ব্র‌্যান্ডের কথা। ২০০৯-তে তাঁদের ভারত সফরের সময় ব্রিটিশ অভিনেতা রাসেল ব্র‌্যান্ড মার্কিন গায়িকা কেটি পেরিকে ‘প্রপোজ’ করেন তাজমহলের সামনে। এক বছর পরে, ২০১০-এ, তাঁরা আবার ভারতে আসেন, বিয়ে করতে। তাঁরা বিয়ের অনুষ্ঠানটা করেন রনথম্বোর অভযারণ্যের বাইরে বিলাসবহুল রিসর্টে। ভারতীয় রীতি মেনে হয় সেই বিয়ের অনুষ্ঠান। খানিকটা বলিউড স্টাইলে বা রাজকীয় স্টাইলেও বলা চলে। হাতিতে চড়ে বিয়ে করতে আসেন তাঁরা।

ভারতকে সেরা বিয়ের জায়গা হিসেবে প্রচার করতে দেশের ট্যুরিজমমন্ত্রক অগাস্ট মাসেই এক উদ্যোগ নিয়েছে। ‘ইন্ডিয়া সেজ আই ডু’। তাতে প্রচার করা হয়েছে বিয়ের বিভিন্ন থিম, যেমন সমুদ্রসৈকতে বিয়ে, প্রকৃতির পরিমণ্ডলে বিয়ে, রাজকীয় বিয়ে হিমালয়ের পরিবেশে বিয়ে এবং আরও কিছু। এই প্রচারের লক্ষ্য হল ঐশ্বর‌্যপূর্ণ, জমকালো বিয়ের ঊর্ধ্বে ভারত সম্পর্কিত উপলব্ধিকে নতুন ব্যাখ্যা করা এবং মূল লক্ষ্য নিশ্চয়ই বিয়ের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা।

কিন্তু ভেবে দেখলে, ভারতে বিয়ের বাজারের এই প্রচার পরোক্ষে হয়ে চলেছে অনেকদিন ধরেই। সে কাজটা মূলত করে চলেছে বলিউড এবং ভারতীয জীবনযাত্রা নিয়ে নির্মিত বেশ কিছু দেশি-বিদেশি টিভি সিরিজ। বহু বলিউড ছবিই বিয়ে কেন্দ্রিক এবং অনেক ছবিতেই রয়েছে বিয়ে অনুষ্ঠানের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ রূপরেখা। ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ ১৯৯৪ সালের ছবি, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’ (ডিডিএলজে) ১৯৯৫ সালের। এই ছবিগুলো ভারতীয় সংস্কৃতিকে সেলুলয়েডে রূপায়িত করার কিছু ক্লাসিক উদাহরণ মাত্র। তিন দশক পেরোনোর পরেও ভারতের বিয়ের বাজারে এই ছবিগুলোর প্রভাব কিন্তু এখনও অটুট। এখনও অতিধনীদের বিয়েতে কখনও কোনও বলিউড ছবির পরিমণ্ডলের নবরূপায়ণ ঘটে। আর এই বলিউড সিনেমা কিংবা টিভি সিরিজগুলির মধ্য দিয়ে পরিচিত হয়ে পশ্চিমীরাও কিন্তু ভারতীয় বিয়ের সংস্কৃতির বেশ কিছু রীতিনীতি, যেমন সংগীত, মেহেন্দি, সাতপাক, এসবের মায়াময় ম্যাজিক্যাল আবেশে বিভোর।

ডিডিএলজে’র কথাই ভাবা যাক। একটা ঢোল, পারিবারিক পাচক, পড়শি ফুলওয়ালা, পড়শি দর্জি, ট্র‌্যাডিশনাল ব্যান্ড পার্টি, এসবই ডিডিএলজের অবিচ্ছেদ্য রসায়নের অঙ্গ। যা শেষপর্যন্ত তৈরি করে একটা ‘যা জী লে অপনি জিন্দেগি’-ধরনের ম্যাজিক মুহূর্ত। এর বিনোদন ক্ষমতার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে বৈকি। তিন দশক পরেও বলিউড এবং ভারতীয় বিয়ে দর্পণে বিনোদন এবং অর্থনীতির সেই বন্ধন সুদৃঢ়। বরং তার সম্ভাবনার ক্ষেত্র ইতিমধ্যে আরও বিস্তৃত হয়েছে বলা চলে। সেই অর্থনৈতিক ফায়দাটুকুকে সংগঠিত উপায়ে ধরার কোনও পরিকল্পনা যে এতদিন সেভাবে হয়নি, সেটাই আশ্চর্যের। এই বিয়ের ফুলের মধু হল লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা, যা ভাসছে হাওয়ায় এবং যা সুসংগঠিত উপায়ে আঁকড়ে ধরার অপেক্ষায় রয়েছে মাত্র।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Siliguri | সেবক রোড এবং বর্ধমান রোডের গাছ অন্যত্র প্রতিস্থাপনে পরিবেশ কমিটির বৈঠক

শিলিগুড়ি: শিলিগুড়ির সেবক রোড এবং বর্ধমান রোডে রাস্তা সম্প্রসারনের জন্যে ১৭৯টি গাছ অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে…

1 hour ago

Siliguri | ডেঙ্গি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম সতর্কতা পুরনিগমের

শিলিগুড়ি: ডেঙ্গি পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবার শহরের সমস্ত সরকারি হাউজিং কমপ্লেক্স, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর পরিষ্কার…

2 hours ago

Mumbai | মুম্বইয়ে বিধ্বংসী ধুলোঝড়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাড়াল ৮ , আহত প্রায় ৬০

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মুম্বইয়ের ঘাটকোপারে বিধ্বংসী ধুলোঝড়ের দরুন হোর্ডিং ভেঙে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাড়াল…

2 hours ago

CBSE 2024 | সিবিএসই-র দশমে দার্জিলিং জেলায় সম্ভাব্য প্রথম দেবাং কৌশিক শর্মা, দ্বাদশে সেরা লাবণ্য

শিলিগুড়ি: সিবিএসই (CBSE 2024) বোর্ডের দশম শ্রেণির পরীক্ষায় দার্জিলিং জেলায় সম্ভাব্য প্রথম হল জিডি গোয়েঙ্কা…

3 hours ago

Maharashtra | গড়চিরৌলিতে বড় অভিযান, নিকেশ দুই মহিলাসহ ৩ মাওবাদী

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলি জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যু হল দুই মহিলাসহ…

3 hours ago

Itahar | বাড়িতে বিজেপির ক্যাম্প করার মাশুল! ইটাহারে ঘরছাড়া পরিবার

দীপঙ্কর মিত্র, রায়গঞ্জ: নির্বাচনের দিন বাড়িতে বিজেপির ক্যাম্প অফিস (BJP Camp Office) করায় আক্রান্ত হতে…

4 hours ago

This website uses cookies.