উত্তর সম্পাদকীয়

লক্ষ্য যখন নারী ভোটারের মন জয়

  • মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস

চা বাগানের উপর পড়েছে জ্যোৎস্নার মায়া। পাতা তুলছেন ওঁরা। শ্যামলী ওরাওঁ, বুঝি সোরেন, সঞ্জিদা লাকড়া… বড় আনন্দে। পূর্ণ চাঁদের মায়ায় কচি সবুজে তখন চা পাতার গুণাবলিও পৌঁছে গিয়েছে লোকের মুখে মুখে, পর্যটকরাও এসে দাঁড়িয়ে পড়েন এসময়ের পাতা তোলায় নিজেকে জড়িয়ে রাখতে। আর অপূর্ব দৃশ্য আর মায়ার সাক্ষী হতে।

ক’দিন আগে অনেক পর্যটক সংকোচ উড়িয়ে তাঁদের হাত ধরে তাঁদের বিভিন্ন আদিবাসী উৎসবে নাচছেন, তাঁদের দেওয়া উড়তে, খাজা, দোখনা পরেছেন। ‘একই আমরা’… ‘এসো আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’ – এ বার্তা চা পাতার ডগায় রোদের আলোটুকু পেরিয়ে ঘরে ঢুকে গিয়েছে। দারুণ খুশিও যেমন ওঁরা, প্রাণের আনন্দে মন খুলে দিতে পারে, দুঃখেও অজস্র যন্ত্রণার সাথি হয়ে চোখের জল বরং আটকে রাখতে শিখে গিয়েছে, তবে নিজের প্রাপ্যটুকু অন্তত ভোট উৎসব, ভোট দান আমার মধ্যে আদায় করা, অন্তত দাবি জানাতে শিখেছে।

চড়া রোদ, মেঘের গুমরোনো মুখ, ঝোড়ো হাওয়া এক নিমেষেই প্রকৃতির রূপ বদলে দিয়ে যায়। উত্তরবঙ্গের প্রকৃতির চেনা ছবি কখনও ভয়ংকর কখনও টর্নেডোর মতো অথবা হড়পা বা খরা। যে নদীকে পুজো করে সে নদীও গ্রামকে গ্রাম ভাসিয়ে নেয়। কৃষিজীবী মানুষের লড়াই থমকে যায় না, চলতে থাকে। এরই মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের মা মঞ্জিরা খাতুনদের চোখের জল শুকোয় না।

আমরা নারী, আমরা পারি… এই স্লোগান কয়েক দশকের। এ পরিচয় সেই বৈদিক যুগের পূর্বে প্রাগৈতিহাসিক কিংবা পুরাণ কালেও তাঁদের অসীম ক্ষমতার কথা জেনেছে মানুষ। পিতৃতন্ত্র তা স্বীকার করুক বা নাই করুক। সংসার বাঁচাতে পরিবার রক্ষা করতে নারীর ক্ষমতায়নের পরিচয় বা ক্ষমতার দৃশ্য চোখ এড়ায় না। সত্যিই তাঁরা সব পারেন।

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ভোটার হিসেবে নারীদের সর্বাগ্রে রাখছে বিভিন্ন দল। তাদের প্রচারে সে কথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। নারীর ভোটদান আবশ্যিক ও নির্দ্বিধায় সম্পন্ন করবার ডাক দিচ্ছেন ভোটের প্রার্থী সহ বিভিন্ন রঙে বিশ্বাসী রাজনীতিকরা।

না, এভাবে স্ত্রী লিঙ্গ, তার ক্ষমতায়ন, তাদের অগ্রাধিকার, তাদের আরাম সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, বিভিন্ন প্রকল্প অথবা ভোটদান পর্ব নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারার প্রতিশ্রুতি বিভিন্ন উপদ্রুত এলাকায় চলছে। যত এগিয়ে আসছে ভোটদানের দিন ততই লক্ষ্য করা যাচ্ছে স্লোগান, বিভিন্ন মিডিয়ার প্রচার। একরকম তোষণের রাজনীতি তো লক্ষ্য করাই গিয়েছে সরাসরি, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে শুরু করে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, শিক্ষাশ্রী বিভিন্ন পরিকল্পনায়। প্রচুর মানুষ উপকৃত, দিন আনে দিন খাওয়া বহুজন আবার কাগজপত্রের বেড়া ডিঙিয়ে সেসব হাতে পানও না। আর কন্যাশ্রী রূপশ্রী কথা যতটা জানি, আমার বহু ছাত্রীর কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা নিজেদের সুবিধার্থে সে অর্থ ব্যবহার করছেন, কন্যার শিক্ষা যেমনই হোক। যাইহোক, সমাজের সর্বস্তরে নারীদের সুবিধা দেওয়া নিয়ে শুধু সরকার নয়, চিন্তা করছে, প্রকল্প গঠন বিভিন্ন দলের, বিভিন্ন রঙের নেতৃস্থানীয়রা।

সত্যি কথা, আমরা যখন আমাদের মা জেঠিমাকে ভোট দিতে যেতে দেখেছি বা মাকে দেখেছি ভোট নিতে যেতেও, তখন এই নারীর জন্য পৃথক লাইন হয়তো কোনও কোনও ক্ষেত্রে থাকলেও তাদের সুবিধা নিয়ে বা ভোটপর্বে নারীর অগ্রাধিকার নিয়ে তেমন আলাদা মাথা ঘামানো লক্ষ করিনি। আসলে তখন তো, ‘আরে মশাই বাড়ি যান, নিশ্চিন্তে ঘুমোন, আপনার ভোট হয়ে গেছে।’ একথা শুনতে হত না তেমন। বড়দের হাত ধরে আঙুলে কঠিন পেন্সিলের রঙের কালি লাগাতে খুব উৎসাহে কয়েকবার বুথে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। আমার সহকর্মী ললিতা, কাকলি বা সমাপ্তির মতো শুনতে হয়নি, ‘দিদি ফিরে যান। আপনারটা হয়ে গেছে।’

এই যে পরিস্থিতিগুলো সেগুলো তো থামানো দরকার। ভোটের অগ্রাধিকার সকলের নারী পুরুষ নির্বিশেষে। প্রতিবাদ করেছেন কি মরেছেন। এই ভয় থেকে সম্প্রতি বেরিয়ে আসতে দেখা গেল বেশ কয়েকটি ঘটনার মধ্যে সন্দেশখালি নারীদের। তাঁরা বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকাকে পথ দেখালেন বলতে হয়। এমনকি উত্তরের নাগরাকাটা থেকে শুরু করে ময়নাগুড়ি ব্লক বা বিভিন্ন জায়গায় সন্দেশখালি নেত্রীরা উপস্থিত থেকেছেন। শোভনা রাই, কঙ্গনা চৌধুরী সহ নানা নেত্রী আলিপুরদুয়ার থেকে গয়েরকাটা নাগরাকাটা সম্মেলন করার সাহস পাচ্ছেন। ফলে বিভিন্ন কমিটি জাগ্রত হলে মণ্ডল, ওরাওঁ, বৈদ্য বা খালকোদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষ আর নারীরা আলাদা বল ভরসায় ভোটপ্রদান করবে।

১৪৩১ সমাগত। নারী উন্নয়নে শুধুই কি ভোটদান? আর বল প্রকাশের পর বিভিন্ন অত্যাচারের ভয় দেখানো? কিংবা ঘর থেকে মানুষ তুলে নিয়ে গিয়ে খুনের হুমকি?

সুস্থতা, সমাজবদ্ধতার উদাহরণ এ হতে পারে না। বিশেষত, বৈষম্য দূর করা নারী নীতির সঙ্গে সঙ্গে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স দূর করার মানসিকতা, যা শুধু আইন বানিয়ে দূর করা যায় না। নারীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার বোধ এবং ক্ষমতায়নের একটি ধারণা পরিষ্কার করে দেওয়া গ্রাম থেকে শহরে সর্বত্র প্রয়োজন। নারীর সম্মান বাড়াতে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মশালা কিংবা সচেতনতা বাড়ানোর শিক্ষা একেবারে অঙ্কুর পর্যায় থেকে শুরু করলে মনে হয় নারী সত্যিকার অধিকারী হয়ে উঠবে।

ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। ভারতের ইতিহাসে ক্ষমতার অধিকারী নারী, সরোজিনী নাইডু, রানি লক্ষ্মীবাঈ, রাজিয়া সুলতানা, অহল্যাবাঈ, সাবিত্রী বাঈ ফুলে, সুচেতা কৃপালনী, অরুণা আসফ আলি। ২০২৩-এ উরসলা ভন দেন লিওনের নাম বলা হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে। উনি বেলজিয়ামের। জার্মানি, আমেরিকা, ইতালি সবখানেই এই নেতৃস্থানীয় নারী পথ দেখিয়েছেন।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ‘নারী শক্তি’র কথা ভাষণে বলেছেন। ভারতের ১২টি রাজ্যে পুরুষের তুলনায় মহিলা ভোটার বেশি। মোট ৪৭.১ কোটি নিবন্ধিত মহিলা। ২০১৯ সালের তুলনায় নারী ভোটারদের সংখ্যা ৯.৩ শতাংশ বেড়েছে। সেখানে পুরুষদের ৬.৯ শতাংশ। ১৮ শতকে যা শুরু হয়েছে, সেই নারী ভোটারদের গুরুত্ব রাজ্য রাজনীতিতে এক প্রয়োজনীয় স্থানে উঠেছে।

সাম্প্রতিককালে কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ নির্বাচনে নারীভিত্তিক কল্যাণ প্রকল্পগুলি বড় ভূমিকা নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও তার ব্যতিক্রম নয়। অনেক ক্ষেত্রে নারী ভোটারদের তালিকায় নাম থাকে না বা তাঁরা ভোটদানে অনুপস্থিত হন।

সেই পরিস্থিতিতেই তাঁদের সচেতন করার কাজে আর মহিলাদের নিয়ে ভোটের রণাঙ্গন যেন শক্তিময়ী করে তুলতে চাইছে নানা রং রাজনীতি। ঢেকে ফেলতে চাইছে গেরুয়া, সবুজ বা লাল রঙে।

সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের ছোট্ট টর্নেডো এখানকার কয়েকটি এলাকায় জনজীবন পরিবার বিপর্যস্ত করে গিয়েছে। ছোট শিশু, পরিবার পাখির মতো আগলে রেখেছেন পরিবারের কর্ত্রী স্থানীয়রা। আবার শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ির পর্যবেক্ষক নারীরাও দুর্গতদের সাহায্য করেছেন। না, তাঁরা ভোট প্রার্থী নন। শুধুই মানুষের পাশে দাঁড়াবেন বলে নিজের খানিকটা সময় এখানে দিয়েছেন। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেও চৈত্রের ধুলো সরিয়ে রেখে মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন।

ভোট আছে থাকবে। ভোট প্রার্থী রঙিন হবেন ক্রমশ! মিডিয়ার কল্যাণে অনেকেই জনপ্রিয় মুখ দেখবেন প্রচারমাধ্যমে। কয়েকবছর ধরে এ ধারা চলছে। এবার আবার সবুজে সুনীলের রিল তৈরি হচ্ছে। নারী ভোটার অবশ্যই দাঁড়াবেন ভোটের লাইনে। ভিতরে তাঁদের বরাভয় ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটুকু সব দল নিয়ে নিলে তাঁরা নিশ্চিন্তে পথে নামতে পারেন। জলহীন রুক্ষ দারিদ্র্য আবার নতুন হোক, সবুজে সুনীল চা বাগান থেকে সন্দেশখালি শান্তির গৃহ হয়ে উঠতে পারে। মহিলা চা শ্রমিকদের মধ্যে এভাবেই আবেগ ভালোবাসা চিরন্তন হোক, যেমন দেখা গেল ওদলাবাড়ি মালবাজারের টুনা বাড়ি, ডামডিম চা বাগানে বনমন্ত্রী ও তাঁর সহযাত্রীর উপস্থিতিতে। নারীরা শুধু নয়, সবাই সেই সুন্দরের অপেক্ষাতেই আছি।

(লেখক শিক্ষক ও সািহত্যিক। জলপাইগুড়ির বাসিন্দা)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Sex Worker | ঘরের বৌকে যৌনকর্মী হতে চাপ! কাঠগড়ায় স্বামী-শাশুড়ি

শিলিগুড়ি: সন্তান জন্মের পর থেকেই বাড়ির বৌকে যৌন ব্যবসায় নামানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন খোদ স্বামী…

6 hours ago

Siliguri | গৃহবধূকে দুই মেয়ে সহ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ শাশুড়ির বিরুদ্ধে

শিলিগুড়ি: স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই গৃহবধূকে অত্যাচারের অভিযোগ শাশুড়ি ও ননদের বিরুদ্ধে। দুই কন্যা সন্তান…

8 hours ago

Manikchak | তৃণমূল অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ, কাঠগড়ায় কংগ্রেস

মানিকচক: তৃণমূল (TMC) অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠল কংগ্রেসের (Congress) বিরুদ্ধে। মালদার মানিকচকের…

9 hours ago

Mamata Banerjee | সিপিএমের সঙ্গে নন্দীগ্রামে গণহত্যা ঘটিয়েছিলেন শুভেন্দু-শিশির! নাম না করেই বিস্ফোরক ইঙ্গিত মমতার

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক : নন্দীগ্রাম গণহত্যা নিয়ে ফের বিস্ফোরক মমতা। এবার নাম না করে…

9 hours ago

Malda news | নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

মালদা: নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীর যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করল মালদা জেলা আদালত। এছাড়া…

9 hours ago

Abhijit Ganguli | মমতাকে নিয়ে ফের ‘কুকথা’ অভিজিতের! তৃণমূলের অভিযোগে শোরগোল

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বিচারপতির চেয়ার ছেড়ে জনতার দরবারে হাজির হয়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Abhijit Ganguli)।…

10 hours ago

This website uses cookies.