উত্তর সম্পাদকীয়

উচ্চশিক্ষার পরীক্ষায় গোপনীয়তা কই

  • অংশুমান কর

প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলায় আদালতে সাওয়াল করে এজলাস ছাড়ার সময় বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। অভিযোগ যে, তাঁরই জন্য চাকরি খোয়াচ্ছেন স্কুল শিক্ষকরা। খবরটি পড়ে হতবাক হয়েছি। দুর্নীতি করলেন যাঁরা, যাঁরা টাকা নিলেন এবং যাঁরা টাকা দিয়ে চাকরি কিনলেন, তাঁদের দোষ নেই। দোষী সাব্যস্ত একজন আইনজীবী যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

মুখ্যমন্ত্রীও প্রায় একই কথা বলেছেন। বলেছেন যে, বিজেপি এবং সিপিএম হল মানুষখেকো বাঘের মতো চাকরিখেকো রাজনৈতিক দল। কথাগুলোয় চমক আছে। ভোটের বাজারে জনসভায় মানুষের হাততালিও পড়ে এসব কথা শুনলে। একাংশ মানুষকে হয়তো বিশ্বাস করানো যায়, চাকরি হারাবার মুখে দাঁড়িয়ে পড়েছেন যে সমস্ত যোগ্য প্রার্থীরা, তাঁদের চাকরি হারাবার মূল কারণ বুঝি বিরোধী রাজনৈতিক দল আর বিকাশরঞ্জনের মতো আইনজীবীরা। কিন্তু, এর চেয়ে বড় মিথ্যে আর হয় না।

এতক্ষণে সকলেই প্রায় জেনে গিয়েছেন, কলকাতা হাইকোর্ট ২০১৬ সালের স্কুল শিক্ষকতার এসএসসি নির্মিত পুরো প্যানেল বাতিল করার পক্ষে রায় দিয়েছে যে সমস্ত কারণগুলির ভিত্তিতে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, ওএমআর শিট প্রস্তুত, মূল্যায়ন ও সংরক্ষণ করার দায়িত্বে ছিল যে সংস্থাটি, সেই সংস্থাটির নিয়োগ স্বচ্ছভাবে হয়নি। টেন্ডার না ডেকেই ওই সংস্থাটিকে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংস্থাটি আবার এই কাজের দায়িত্ব চালান করে আরেকটি সংস্থার কাঁধে। সিপিএম বা বিজেপি বা বিকাশরঞ্জনের মতো আইনজীবীরা তো আর টেন্ডার না ডেকে দায়িত্ব ওই সংস্থাকে দেয়নি। এই কাজটির জন্য দায়ী কে? অবশ্যই স্কুল সার্ভিস কমিশন। দায় বর্তাবে সরকার এবং তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর ওপরেও।

উচ্চশিক্ষার সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকার সুবাদে একাধিকবার স্নাতক স্তরের পরীক্ষায় প্রধান পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কথায় কথায় আরটিআই করার চল যখন এ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবেশ করেনি, তখনও দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পরীক্ষার উত্তরপত্র যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হত। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় আজও প্রথাটি অনুসরণ করা হয়। কোথাওই এক বা দু’বছরের মধ্যে পরীক্ষার উত্তরপত্র নষ্ট করে দেওয়া হয় না। অথচ স্কুল সার্ভিস কমিশন ঠিক এই কাজটিই করেছে। কমিশনের আইনে এই সুযোগ ছিল না। ২০১৬ সালের পরীক্ষার আগে তাই আইনের পরিবর্তন করা হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে ঠান্ডা মাথায় অত্যন্ত বড় আকারে একটি দুর্নীতি সংগঠিত করার জন্য গুছিয়ে মাঠে নেমেছিল শাসকদল।

মজার ব্যাপার হল মিরর ইমেজ না রেখেই ওএমআর শিটগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। দুর্নীতি করা হবে এবং সেই দুর্নীতি জনসমক্ষে এলে যাতে কিছুতেই প্রমাণ করা না যায়, এমন খেলো ধারণা থেকেই এইসব পদক্ষেপ করা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত শেষরক্ষা হয়নি। ওএমআর শিটগুলির হার্ডকপি থাকলে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের এতখানি বিপদে পড়তে হত না। দায় তাই স্কুল সার্ভিস কমিশনের ঘাড়েই পড়বে। দায় নিতে হবে শাসকদলটিকেও।

কলকাতা হাইকোর্টে মামলা চলাকালীন স্কুল সার্ভিস কমিশন যোগ্য প্রার্থীদের কোনও তালিকা হলফনামা দিয়ে জমা দেয়নি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে মামলার রায় বেরোনোর পর কমিশনের চেয়ারম্যান যে কথাগুলি বলেছেন সেগুলি অভূতপূর্ব। একবার বলেছেন, আদালতের নাকি ধরে নেওয়া উচিত ছিল যে নামগুলি অযোগ্য প্রার্থীদের তালিকায় নেই, সেগুলিই যোগ্যদের নাম। আবার একবার বলেছেন, এই নামগুলির বাইরে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন তাঁদের নিয়োগে যে কোনও স্তরে কখনও কোথাও কোনও দুর্নীতি হয়নি এই হলফনামা তিনি দেবেনই বা কী করে! আরও একবার বলেছেন যে, আদালত থেকে চাওয়া হয়নি বলেই যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা আদালতে জমা দেওয়া হয়নি। মামলা মোকদ্দমা সংক্রান্ত সাধারণ জ্ঞান যাঁদের আছে তাঁরা সকলেই জানেন, আদালত না চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে একাধিক হলফনামা জমা দেওয়া যায়। যোগ্য প্রার্থীদের কথা ভেবে সেই উদ্যোগটি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাই বোধ করেনি স্কুল সার্ভিস কমিশন। দায় কার?

আদালতের পর্যবেক্ষণে কড়া মন্তব্য করা হয়েছে সুপার নিউমেরারি পোস্টগুলি নিয়ে। মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া প্যানেল থেকে চাকরি হয়েছে, প্যানেলে নাম না থাকা প্রার্থীদের চাকরি হয়েছে, এসব জানার পরেও কী করে একটি সরকার এভাবে চাকরি পেয়েছেন যাঁরা, তাঁদের চাকরিকে সুরক্ষা দিতে সুপার নিউমেরারি পোস্ট তৈরি করতে পারে? বলা হচ্ছে যে, এইভাবে একজনেরও নিয়োগ হয়নি। নিয়োগ হওয়াটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন যাঁরা, তাঁদের চাকরি বাঁচানোর দায় যদি সরকার গ্রহণ করে, তাহলে বোঝাই যায় যে দুর্নীতিকে আদৌ পাত্তা দিচ্ছে না সরকার। সরকারের এই মনোভাবই আদালত ভালোভাবে নেয়নি। দুর্নীতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর এই চেষ্টা কি সিপিআই(এম), বিজেপি বা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য করেছেন?

বলা হচ্ছে যে, বিকাশ পুরো প্যানেল বাতিলের জন্য সওয়াল করেছেন আদালতে আর সিপিএম পার্টির ছাত্র-যুব সংগঠন যোগ্য প্রার্থীদের জন্য পথে নেমেছে, শিক্ষক সংগঠনটি সহায়তা দিচ্ছে যোগ্য প্রার্থীদের– এ হল দ্বিচারিতা। আদালতে বিকাশ যা সওয়াল করেছেন তা যে সম্পূর্ণভাবেই সিপিআই(এম) পার্টিরই বক্তব্য ছিল, সেটি ধরে নেওয়ার কোনও সংগত কারণ আছে কি? এর আগেও প্রকাশ্য রাজপথে বিকাশ গোমাংস ভক্ষণ করেছিলেন। এই কাজটিতেও কি পার্টির সমর্থন ছিল? তাই আইনজীবী বিকাশ আদালতে যে সওয়াল করবেন, তার সম্পূর্ণ দায়টি তাঁর দলের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া আসলে ঘোলা জলে মাছ ধরবার প্রয়াস মাত্র।

উচ্চশিক্ষার সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকার ফলে এটুকু নিশ্চিত হয়েছি যে, গত তেরো বছরে এ রাজ্যে উচ্চশিক্ষার হাল ক্রমশ খারাপ থেকে অত্যন্ত খারাপ হয়েছে। একটি উদাহরণ দিই। ২০১১ সালের আগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে যে গোপনীয়তা রক্ষা করা হত, আজ আর তা নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ছাপা হচ্ছে কোনও ছাপাখানায়, ট্যাবুলেশন করছেন কারা, অ্যাডমিট এবং রেজাল্ট বানাচ্ছেন কারা এসব তথ্য আজ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা তো বটেই এমনকি ছাত্রছাত্রীরাও জানে। অথচ একটা সময় ছিল যখন এই সংস্থাগুলির নাম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বা দুজন ব্যতীত কেউই জানতেন না। এদের পরিচয় ছিল কতগুলি কোড নম্বর বা নাম।

চব্বিশ বছর ধরে শিক্ষকতা করার পর এখন এই প্রশ্ন নিজেকেই করতে ইচ্ছে করে যে, একটি ছাত্র বা ছাত্রী আজ উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশ করবে কী আশায়? এই সরকার প্রমাণ করতে পেরেছে, সৎ পথে পড়াশোনা করে চাকরি পাওয়া আজ পশ্চিমবঙ্গে অসম্ভব। বাইরের যে কোনও রাজ্যে পড়াশোনা সংক্রান্ত কোনও কাজে গেলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের থেকে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষা সম্বন্ধে যে সম্ভ্রমসূচক মন্তব্যগুলি কিছু বছর আগেও শুনতাম, সেগুলির বদলে আজ শোনা যায় ঠাট্টা বিদ্রুপ।

বাংলার উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাটিকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে অনেকগুলি বছর লাগবে। তবে সময়ের চেয়েও এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সদিচ্ছা। মুখ্যমন্ত্রী বলেননি, কিন্তু আদালতের রায় শোনার পর বর্তমান উচ্চশিক্ষামন্ত্রী বলেছেন যে, তাঁরাও চান যোগ্য প্রার্থীদের চাকরি থাকুক, অযোগ্যদের চাকরি যাক। এই কথা শুনে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে, উচ্চশিক্ষাকে হৃতগৌরব ফিরিয়ে দেবার সদিচ্ছা উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর আছে। এই কাজটি খুবই কঠিন। ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ বলেই তাঁকে দল এবং অন্যান্য নানা অংশের চাপকে এড়িয়ে এই কাজে অবিলম্বে হাত লাগাতে হবে। সময়ের দাবি কিন্তু এটাই।

(লেখক সাহিত্যিক ও অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায় এয়ারভিউ মোর সংলগ্ন মহানন্দা সেতুর নিচেই দিনে দুপুরে চলছে জুয়ার আসর।…

2 mins ago

Siliguri | বৃষ্টিতে ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ার শঙ্কা, নজরদারি বাড়াচ্ছে পুরনিগম

রাহুল মজুমদার, শিলিগুড়ি: বৃষ্টি নিয়ে দোলাচলে শিলিগুড়ি (Siliguri) পুরনিগমের দুই দপ্তর। জল সংকটের মাঝে বৃষ্টিতে…

3 mins ago

COVID-19 | ফের থাবা করোনার! সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত প্রায় ২৬ হাজার

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সিঙ্গাপুরে (Singapore) নতুন করে থাবা বসাল করোনা ভাইরাস (COVID-19)। করোনার নতুন…

21 mins ago

Elephant | ফের জঙ্গলে রুটিন টহলদারিতে শিলাবতী

ময়নাগুড়ি: দেখতে দেখতে তিন মাসের বেশি সময় হয়ে গেল। রামশাই (Ramsai) মেদলা ক্যাম্পের জঙ্গলে সেভাবে…

33 mins ago

Health Care Centre | উদ্বোধনের পাঁচ মাস পরেও অচল স্বাস্থ্যকেন্দ্র

কার্তিক দাস, খড়িবাড়ি: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee) ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেছিলেন অধিকারীর বারাসতভিটার সুস্বাস্থ্যকেন্দ্র…

49 mins ago

Gojoldoba | তিস্তার পলিতে বাদাম উৎপাদনে ভাটা, দুর্দশায় গজলডোবা

সানি সরকার, গজলডোবা: প্রাক বর্ষায় চারদিক সবুজময়। কিন্তু মাটির নীচের ‘চেনা সোনা’ উধাও। গত কয়েকমাসের…

1 hour ago

This website uses cookies.