- ভূপেশ রায়
বাহারি সবুজ চা বাগান, গভীর অরণ্য, বন্যপ্রাণী সহ নানা প্রাকৃতির সৌন্দর্যে ভরপুর যেমন জলপাইগুড়ি জেলা, তেমনই বর্তমানে এরাজ্যে শিক্ষার দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা অন্যতম জেলাটির নামও জলপাইগুড়ি! এ যেন একই মুদ্রার দুটো দিক। গত কয়েক বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলের দিকে লক্ষ রাখলেই বোঝা যায় এ জেলার শিক্ষার হাল কতটা বেহাল!
২০২৩ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার গোটা রাজ্যের গড় পাশের হার যেখানে ৮৫.১৫ শতাংশ, সেখানে জলপাইগুড়ি জেলার পাশের হার ৬৯ শতাংশ। এবছর মাধ্যমিকের ফলাফলে যেখানে পশ্চিমবঙ্গের গড় পাশের হার ৮৬.৩১ শতাংশ সেখানে জলপাইগুড়ি জেলার পাশের হার ৭৩.০৯ শতাংশ। উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলেও বিগত কয়েক বছর থেকে গোটা রাজ্যে পিছিয়ে এই জেলা। রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের কাছেও এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরি, কেন এই জেলার শিক্ষার আজ এত বেহাল।
জলপাইগুড়ি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চা বাগান, যেখানে আদিবাসী শ্রমিকদের বসবাস। কিছুদিন আগে লাটাগুড়ির পার্শ্ববর্তী নেওড়া নদী চা বাগান ও আনন্দপুর চা বাগান এলাকায় ঘুরে বুঝতে পেরেছি উত্তরের প্রত্যন্ত চা বাগান এলাকাগুলির শিক্ষা পরিকাঠামোর হাল কতটা শোচনীয়। বিশেষত ভাষাগত সমস্যাটি অন্যতম কারণ। এখানকার আদিবাসী বেশিরভাগ পড়ুয়া প্রাথমিক স্তরে হিন্দিমাধ্যমে পড়াশোনা করলেও হিন্দিমাধ্যম হাইস্কুল পার্শ্ববর্তী এলাকায় তেমন নেই। তাছাড়া স্কুলগুলির পরিকাঠামোগত সমস্যা তো আছেই।
প্রতিবছর মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর যখন চা বাগান এলাকার শিক্ষার কঙ্কালসার দিকটি সকলের সামনে ফুটে ওঠে, তখন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক গণমাধ্যমে এবিষয়ে দু’একদিন আলোচনা হয়। সারাবছর শিক্ষা দপ্তর হোক বা জেলা প্রশাসন কারও কোনও হুঁশ থাকে না এবিষয়ে।
কেন উত্তরবঙ্গের চা বলয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ছেড়ে শ্রমিকের কাজে যোগ দিচ্ছে? তারা কেন এখনও শিক্ষার উপযুক্ত পরিকাঠামো থেকে বঞ্চিত? সরকারি প্রকল্পগুলির পরিষেবা চা বাগান এলাকার শিক্ষার্থীরা ঠিকঠাক পাচ্ছে তো? কেন তারা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা শিক্ষা দপ্তরের চেয়ারে বসে থাকা বাবুরা কখনোই করেননি। একজন মূলধারার সমাজের শহর এলাকার শিক্ষার্থী যে সুযোগসুবিধাগুলি পায়, একজন চা বাগান এলাকার শিক্ষার্থী সেই সুবিধাগুলির সিকি অংশও পায় না। তাড়াছা সরকারি উদাসীনতা তো আছেই।
এবছর দেখা গেল যে শিক্ষা দপ্তর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময়সূচি সকাল ১১টার পরিবর্তে সকাল ৯টায় করেছে! বিষয় হল মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে দক্ষিণবঙ্গে ঠান্ডার প্রকোপ না থাকলেও উত্তরবঙ্গে ঘন কুয়াশা ও ঠান্ডার প্রকোপ থাকেই। উত্তরের প্রত্যন্ত চা বাগান এলাকার পরীক্ষার্থীরা এত সকালে কীভাবে পরীক্ষাকেন্দ্রে যাবে সেকথা একবারও কেন ভাবল না শিক্ষা দপ্তর তা বেশ আশ্চর্যজনক!
ব্যক্তিগতভাবে মনে করি উত্তরবঙ্গের চা বাগান অধ্যুষিত এলাকাগুলোর শিক্ষা পরিকাঠামোগত উন্নতির জন্য বিশেষ উন্নয়ন বোর্ড গড়ে তোলা দরকার। একদিনে হয়তো পরিবর্তন আসবে না, কিন্তু শিক্ষা দপ্তর যদি এখন থেকেই উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে তবে আগামী কয়েক বছরে এর সুফল পাওয়া সম্ভব। নয়তো অনাদর ও অবহেলায় এই জেলাগুলি আরও পিছিয়ে যাবে।
(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। ময়নাগুড়ির বাসিন্দা)