কলাম

বাংলায় শিক্ষার কফিনে শেষ পেরেক

  • দীপ সাহা

সরস্বতীপুজোর দিন শিলিগুড়ির কলেজপাড়ার একটি স্কুলের পাশ দিয়ে ফিরছিলাম। পাশের পুজোমণ্ডপ থেকে হঠাৎ মাইকে ভেসে এল, ‘তুনে মারি এন্ট্রিয়া রে, দিল মে বাজি ঘন্টিয়া রে…’। মনে তখনই কেমন যেন ঘণ্টী বেজে উঠল। অন্তরাত্মাকে প্রশ্ন করলাম, সরস্বতীপুজোয় এমন গান! সত্যিই বাঙালির অনেক ‘উত্তরণ’ হয়েছে!

ঠিক এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরের জাতীয় শিক্ষানীতির প্রথম বর্ষের ফলপ্রকাশ হল। যা দেখে শুধু চক্ষু ছানাবড়া হওয়া নয়, রীতিমতো হৃত্কম্পন থেমে যাওয়ার জোগাড়। ৯৪ শতাংশ পড়ুয়াই সব বিষয়ে পাশ করতে পারেনি। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। তারপর পরিসংখ্যান দেখে বিস্মিত হতেই হল।

করোনাকালের পর বাংলায় শিক্ষার হাল নিয়ে একাধিক সমীক্ষা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গলদ গোড়াতেই। একেবারে প্রাথমিক স্তরের একটি সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়ারা দ্বিতীয় শ্রেণির বই রিডিং পড়তে হিমসিম খাচ্ছে। উচ্চারণ করতে হোঁচট খাচ্ছে বারবার। ১০ জন পড়ুয়ার মধ্যে সাধারণ যোগ-বিয়োগ করতে পারছে মাত্র চারজন। এই হিসেবই বুঝিয়ে দেয় বাংলার প্রাথমিক শিক্ষার করুণ অবস্থাটা।

২০২০ সাল থেকে প্রায় তিন বছর করোনার জন্য সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা ভারতে। অনলাইন ক্লাসের ফাঁদে পড়ে শিশুমন কীভাবে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে, তা অভিভাবকরা জানেন। বড়দের কথা তো ছেড়েই দিলাম। মোবাইল আসক্তিতেই পড়াশোনার মান নামছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

ছাত্রজীবনে শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন ভালো শিক্ষকই পারেন ছাত্রকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে। কিন্তু বাংলায় শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের কারণে শিক্ষকদের একাংশের যোগ্যতা এখন আতশকাচের তলায়। এই অনিয়মের অভিযোগে ইতিমধ্যে চাকরি খুইয়েছেন শয়ে-শয়ে ভুয়ো শিক্ষক। বাকিটা এখনও আদালতে বিচারাধীন। আবার দীর্ঘদিন নিয়োগ না হওয়ায় পড়ে রয়েছে শিক্ষকের হাজার হাজার শূন্যপদ। সেই পদে নিয়োগ কবে হবে, কেউ জানে না।

অগত্যা যা হওয়ার তাই হচ্ছে। শিক্ষকের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্কুল। মালবাজার থেকে মালদা- একই হাল। উলটোটাও আছে। বেহাল অবস্থার কারণে সরকারি স্কুলে ছেলেমেয়েদের পাঠানো বন্ধই করে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। বাড়ছে ড্রপআউটের সংখ্যাও। বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটা মারা হয়েছিল তিন দশক আগে জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন। প্রাথমিক স্তরে পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তখন কম সমালোচনা হয়নি।

তারপর দ্বিতীয় দফায় ২০০৯ সালে কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার থাকাকালীন আরেকবার সেই ‘ভুল’। শিক্ষার অধিকার আইনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইউপিএ সরকার। বাংলায় তা কার্যকর হয় ২০১২ সালে। সেটা যেন শেষের শুরু। তৃণমূল সরকার দু’-একবার পাশ-ফেল প্রথা ফেরাতে কেন্দ্রের কাছে তদ্বির করেছে বটে, কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। বরং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটব্যাংকের স্বার্থে যেভাবে কোভিডকালের আগে ও পরে পড়ুয়াদের সবাইকে পাশ করিয়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন, তাতে বিপদ আরও বেড়েছে।

রাজ্যের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গত শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০। এ বছর যাঁরা নতুন শিক্ষানীতিতে প্রথম সিমেস্টারের পরীক্ষা দিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকে করোনাকালে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের পড়ুয়া ছিলেন। এঁরাই প্রথম ব্যাচ, যাঁরা পরীক্ষা না দিয়ে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক উতরে গিয়েছেন। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

কথা হচ্ছিল শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যক্ষ সুজিত ঘোষের সঙ্গে। তিনি মনে করছেন, করোনাকালের পর পড়াশোনার অভ্যাসটাই চলে গিয়েছে। এই অভ্যাস ফেরাতে সরকারের কোনও পরিকল্পনা আছে কি না, কেউ জানে না। উত্তরের আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় পঞ্চানন বর্মায় ফলপ্রকাশ হবে কিছুদিনের মধ্যে। সেখানেও আগাম বিপর্যয়ের আভাস। এক অধ্যাপকের কথায়, ‘কলেজের পড়ুয়ারা পরীক্ষার খাতায় কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং লিখে চলে আসছেন। বাক্যগঠন তো দূর, বিষয়ের সঙ্গে কোনও সামঞ্জস্য নেই। শুধু খাতা ভরানো হয়েছে কোনও মতে। এভাবে নম্বর দেওয়া যায় নাকি!’

তাঁর আশঙ্কা, মোটের ওপর ফল এবার ভালো হবে না। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অত খারাপ না হলেও পাশের হার অনেক কমবে। উত্তরের অঘোষিত এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় এনবিইউ। সেখানে ফেলের হার দেখে ভ্রূ কোঁচকাচ্ছে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক আবার বর্তমান স্নাতক স্তরের পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

তিনি বলছেন, ‘এমনিতেই প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্তে চাকরির বাজার শেষ। ওঁদের এমন রেজাল্ট দেখলে তো ভবিষ্যতে কেউ চাকরিই দেবে না।’ ওই অধ্যাপকের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা বলছে সর্বভারতীয় একটি গবেষণা। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনও স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় না সরকারের কাছে। রাজ্যের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু তো নাটক ও সিনেমা নিয়ে বেশি ব্যস্ত। তাঁর এসব ভাবার অবকাশ কোথায়!

এসব দেখলে হীরক রাজার কথা খুব মনে পড়ে। আমাদের মন্ত্রী-মহোদয়রা যেন বারবার মনে করিয়ে দেন, ‘লেখাপ়ড়া করে যে, অনাহারে মরে সে।’ সেই হীরক রাজাকে পালটা প্রশ্ন করার মতো একটাও উদয়ন পণ্ডিতকে আর দেখি না বাংলায়।

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Ebrahim Raisi। ইরানের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ভেঙে পড়ল কপ্টার, খারাপ আবহাওয়ায় বিঘ্নিত উদ্ধারকার্য

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আজারবাইজান সীমান্ত থেকে ফেরার পথে দূর্ঘটনার কবলে পড়ল ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম…

5 hours ago

Money seized | হাওয়ালা ব্যবসায়ীদের ডেরায় হানা বিহার পুলিশের, নেপাল সীমান্ত রকসলে উদ্ধার ৯৪ লক্ষ টাকা

কিশনগঞ্জঃ নির্বাচনের মাঝেই ফের লক্ষ লক্ষ দেশি-বিদেশি টাকা উদ্ধার করল বিহার পুলিশ। রবিবার এই বিপুল…

7 hours ago

Cooch Behar | অক্সফোর্ডে সাফল্য কোচবিহারের মেয়ের, খুশির হাওয়া জেলাজুড়ে

কোচবিহার: এবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও সাফল্যের চিহ্ন রাখল কোচবিহার। শনিবার বিশ্বসেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ…

7 hours ago

Belacoba | রাস্তা নির্মাণে নিম্নমানের কাজের অভিযোগ, প্রতিবাদে তুমুল বিক্ষোভ গ্রামবাসীদের

বেলাকোবাঃ রাস্তা নির্মাণে নিম্নমানের কাজের অভিযোগে সরব হলেন গ্রামবাসীরা। ঘটনাটি জলপাইগুড়ির সদর ব্লকের বেলাকোবা গ্রাম…

7 hours ago

Raiganj | ত্রিপুরার ব্যবসায়ী খুন কাণ্ড, রায়গঞ্জ থেকে ধৃত মূল পাণ্ডা

রায়গঞ্জ: অবশেষে ধরা পড়ল ত্রিপুরার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী দুর্গাপ্রসন্ন দেব খুনের মূল পাণ্ডা রাকেশ বর্মন (৩৩)।…

8 hours ago

Kidnap | যুবতীকে অপহরণ! অপহৃতার খোঁজে তল্লাশি পুলিশের, গ্রেপ্তার মূল অভিযুক্তের কাকা

রায়গঞ্জঃ এক তরুণীকে অপহরণ করে অন্যত্র লুকিয়ে রাখার অভিযোগে মূল অভিযুক্তের কাকাকে গ্রেপ্তার করল রায়গঞ্জ…

8 hours ago

This website uses cookies.