অরূপ গুহ
যন্ত্র দিয়ে হাতি তাড়ানোর ভিডিও দেখে বুক কেঁপে উঠেছে। সত্যিকারেই আমরা অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। বন ও বন্যপ্রাণী সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতা অনেক আগেই বিপদসীমা পার করে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা সচেতন হইনি। বছর বছর লোকদেখানো বন্যপ্রাণী সপ্তাহ পালন করা হয়। শহরের কোনও হলঘর বা শপিং মলে সাজিয়ে গুছিয়ে আয়োজন হয়। সেখানে বন, বন্যপ্রাণীর চাইতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। ফেসবুকে ছবি পোস্ট হয়। তবে কিছুই শেখা যায় না।
যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তারজন্য শুধু বন দপ্তর দায়ী তা নয়। আমরা যারা ‘জনগণ’ তাদের দায়বদ্ধতাও সমান। পরিবেশপ্রেমী সংগঠনগুলি সবসময় ঠিক জায়গায় যেতে পারে না। কিছু কর্মশালা হয় ঠিকই, তবে সেগুলিতে শিক্ষা একেবারই কম, আর প্রচার অনেক বেশি। বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে মানুষের সংযোগ বাড়াতে অতীতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সরকারি উদাসীনতায় সেসবও বন্ধ। বিভিন্ন বনাঞ্চলে প্রকৃতি বিক্ষণকেন্দ্রগুলিতে পরিকাঠামো গড়ে স্কুল পড়ুয়া, শিক্ষার্থীদের জন্য সচেতনতামূলক ছবি, চলচ্চিত্র দেখানো হত। তাতে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক তৈরি হত শিক্ষার্থীদের। সেই পরিকাঠামো ব্যবহার করে এখন নানা সরকারি বৈঠক হয়।
জনসচেতনতা বিষয়টি কার্যত উঠেই গিয়েছে। সরকারি বিজ্ঞাপন দিয়ে হাতি, গন্ডার দেখতে উত্তরবঙ্গে আসতে বলা হচ্ছে। তবে জঙ্গলে গিয়ে কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয় সেসব শেখানো হচ্ছে না। নজর শুধুই রাজস্ব বৃদ্ধির ওপর। রেকর্ড টিকিট বিক্রি হলে বাহবা কুড়োচ্ছেন বনকর্তারা। মানুষের বিনোদনের জন্য বন্যপ্রাণীদের জীবনযাত্রা নিয়েও কেউ ভাবছে না। সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্যে চিড়িয়াখানায় নিশাচর বন্যপ্রাণীদের দিনে ঘুমানোর পরিবেশ করে দেওয়ার বদলে জাগিয়ে রাখা হচ্ছে শুধুমাত্র আমাদের বিনোদনের জন্য। এগুলো নিয়ে কেউ ভাবে না, প্রশ্ন তোলে না। সব নজর শুধু রাজস্ব বৃদ্ধির দিকেই।
উত্তরবঙ্গকে পর্যটন মানচিত্রে তুলে ধরতে গিয়ে বন্যপ্রাণীদের চাইতে জঙ্গলে অনেক বেশি মানুষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমলা, ব্যবসায়ী, নেতা, মন্ত্রী, পরিবেশকর্মীদের মতো ‘সভ্য’দের সভায় পর্যটনের নামে বুনোদের প্রজননের সময়ও জঙ্গলে প্রবেশের দাবি উঠছে। তবুও আমরা লজ্জিত হচ্ছি না। বিদেশে বন্যদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি করতে নানা অভিনব উদ্যোগ দেখা যায়। বিভিন্ন সরকারি সভায় সেসব চালুর প্রস্তাব দিয়েছি। তবে কাজ হয়নি।
বন্যপ্রাণী বলতে এখন আমরা শুধু হাতি, গন্ডার, বাঘ বুঝি। বাঁদর, হরিণ, সাপ এদের সেই অর্থে কোনও গুরুত্বই নেই। হাতি মরলে হইচই হয়। কিন্তু বাঁদর মরলে হয় না। চারিদিকে বন্যপ্রাণীদের ওপর যেভাবে অত্যাচার হচ্ছে তা বন্ধে সবথেকে বেশি জরুরি শিক্ষা। সেই উদ্যোগটা সরকারি, বেসরকারি সব দিক থেকেই আসা দরকার।