বার্লিন, ১৫ জুলাই : ডে লা হু? বাংলায় এর অর্থ ডে লা আবার কে? প্রায় ১৮ মাস আগে এই তিনটি শব্দ ব্যবহার করে তাঁকে নিয়ে নেটপাড়ায় কটাক্ষ, সমালোচনার বন্যা হয়েছিল। কারণ, সেসময় সিনিয়ার পর্যায়ে কোচিং করানোর কোনও অভিজ্ঞতাই তাঁর ছিল না। তিনি লুইস ডে লা ফুয়েন্তে। স্পেনের কোচ হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর যোগ্যতা নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁরা এখন কোথায়? গত দুই বছরে নয়, বার্লিনের মায়াবী রাতের রূপরেখা তৈরির কাজ তিনি ১১ বছর আগে থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন।
২০১২ সালে ইউরো জয়ী স্পেনের নিউক্লিয়াস হিসাবে যদি জাভি অলন্সো, আন্দ্রে ইনিয়েস্তা ও জাভি হার্নান্ডেজকে ধরা হয়, তাহলে এবার তাদের চালিকাশক্তিদের মধ্যে ছিলেন রড্রি, ড্যানি ওলমো ও ফ্যাবিয়ান রুইজ। ২০১৩ সালে স্পেনের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই তিনজনের সঙ্গেই কাজ করেছিলেন ফুয়েন্তে। শুধু তাই নয়, উনাই সিমোন, মার্ক কুকুরেলা, মিকেল মেরিনো, ফেরান টোরেস, মিকেল ওয়ারজাবালদের বয়সভিত্তিক ফুটবলে কোনও না কোনও সময় গুরুর ভূমিকা পালন করেছিলেন ফুয়েন্তে। স্কোয়াডের অধিকাংশ ফুটবলারের নাড়ি নক্ষত্র তাঁর জানা। তাই ভবিষ্যতের স্পেন গড়তে ভবিষ্যৎ তারকাদের সঙ্গে কাজ করা এমন একজনকেই নিয়োজিত করতে চেয়েছিল স্প্যানিশ ফেডারেশন। তাতেই চেক মেট।
জহুরির চোখ রত্ন চিনতে ভুল করেনি। অভিজ্ঞতা ও বয়সের তোয়াক্কা না করে দুই প্রান্তে দুই প্রাণবন্ত তরুণকে নিয়ে এলেন। একজন সতেরো বছরের লামিনে ইয়ামাল, অন্যজন একুশের নিকো উইলিয়ামস। তাঁদের যুগলবন্দি যে স্পেনের ১২ বছরের অপেক্ষা মেটানোর অন্যতম প্রধান অস্ত্র ছিল, সেই নিয়ে দ্বিমত হবে না। শুরুতেই তিকিতাকা ফুটবলকে ‘আদিওস’ জানিয়ে আক্রমণাত্মক প্রেসিং ফুটবলে জোর দিলেন ফুয়েন্তে। তাতেই গত এক দশক ধরে বড় মঞ্চে সাফল্যের সন্ধানে ধুঁকতে থাকা স্পেন হয়ে ওঠে অশ্বমেধের ঘোড়া। তাঁর পরিকল্পনার কার্যকারিতা ইউরোর প্রথম ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার দিনই বুঝেছিল ফুটবলবিশ্ব।
তাঁর দল চতুর্থবার ইউরোপ সেরা হয়ে ইতিহাস গড়েছে। তবুও বার্লিনের ঐতিহাসিক রাতে দাঁড়িয়ে ফুয়েন্তে অবলীলায় বলে গেলেন, ‘অল্প সময়ে এতটা উন্নতি করা খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু আমি চাইব আমার ফুটবলাররা আরও উন্নতি করুক। ওরা অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারে। এভাবেই ওরা দেশকে আরও সাফল্য এনে দেবে। নতুন প্রজন্ম আমাদের গর্বিত করেছে। যারা এভাবে ইতিহাস তৈরি করতে পারে, আগামীদিনে তারা আরও সাফল্য পাবে, এটা আমার বিশ্বাস।’ সরাসরি না বললেও তিনি যে ২০২৬ সালের বিশ্বকাপকে ইঙ্গিত করে কথাগুলি বলেছেন, তা স্পষ্ট।
নতুন ঘরানার স্প্যানিশ ফুটবলকে বিশেষজ্ঞরা ‘নয়া তিকিতাকা’ নাম দিয়েছেন। বিপক্ষকে চমকে দাও, এই আদর্শে যে সাফল্য এসেছে সেই কথা জানিয়ে ফুয়েন্তের বক্তব্য, ‘আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী ফুটবলাররা যে খেলতে পারবে, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। আমরা বিপক্ষকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম। আমরা ম্যাচগুলি নিয়ন্ত্রণে রেখে গতিতে মাত দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। দলে গতিশীল ফুটবলার না থাকলে এই পরিকল্পনা কখনোই সফল হত না। এমন দাপটের সঙ্গে স্পেনকে বহু বছর পর কোনও ট্রফি জিততে দেখলাম।’
এবারের দলটার ব্যান্ডমাস্টার ছিলেন রড্রি। যোগ্য হিসাবে যে তিনি ইউরো কাপের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন, সেই নিয়ে কোনও দ্বিমত থাকার কথা নয়। ছোটবেলার ছাত্রকে প্রশংসায় ভরিয়ে ফুয়েন্তে বলেছেন, ‘দয়া করে ওকে ব্যালন ডি’অর দেওয়া হোক। এই মুহূর্তে ও-ই বিশ্বের সেরা ফুটবলার।’ গত এক মাসের ফুটবলযজ্ঞের পর বলাই যায়, স্প্যানিশ ফুটবলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হাতে রয়েছে।