মুখ্যমন্ত্রীর পাড়া তথা বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরে জাল ওষুধের ফলাও কারবার। সম্প্রতি এলাকার একটি পাইকারি ওষুধের দোকান ও গোডাউন থেকে ৬.৬ কোটি টাকার জাল ওষুধ বাজেয়াপ্তের খবরে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। শুধু কলকাতায় নয়, উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে সারারাজ্যে। কেননা, মূলত কলকাতা থেকে যাবতীয় ওষুধ সরবরাহ হয় জেলায় জেলায়।
সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন ও ড্রাগ কন্ট্রোল ডিরেক্টরেট যৌথভাবে তল্লাশি চালিয়ে এই বিপুল পরিমাণ জাল ওষুধ বাজেয়াপ্ত করেছে। দোকানের মালকিনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাজেয়াপ্তের তালিকায় রয়েছে ক্যানসার, ডায়াবিটিসের মতো বিভিন্ন রোগের ওষুধ। বহু ওষুধের মোড়কে উৎপাদনকারী হিসেবে আছে বাংলাদেশ, তুরস্ক, আয়ারল্যান্ড, আমেরিকার নাম।
তল্লাশির সময় আধিকারিকরা আমদানি সংক্রান্ত নথি দেখতে চাইলে দোকান ও গোডাউনকর্মীরা কিছু দেখাতে পারেননি। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক পুরো বিষয়টির ওপর নজর রাখছে। ওষুধের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। জাল ওষুধের চক্র ফাঁসের ঘটনা অবশ্য কলকাতায় এটা প্রথম নয়। কিছুদিন আগে গড়িয়ার বোড়ালে জাল ওষুধের একটি সংস্থার সন্ধান মিলেছিল। সংস্থাটি ছিল আসলে প্রসাধন সামগ্রী নির্মাতা। কিন্তু বেআইনিভাবে ওষুধের কারবার চালাত।
ওই সংস্থার কারবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরও মাসখানেক আগে কলকাতার একটি সরকারি হাসপাতালে এক রোগীকে জাল ওষুধ দেওয়া নিয়ে তুমুল শোরগোল হয়েছিল। আবার আরজি কর মেডিকেল কলেজে আর্থিক দুর্নীতির তদন্তে নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহের ঘটনা সামনে এসেছিল। আরও আগে থেকেই ওই মেডিকেল কলেজে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতেন বলেই নির্যাতিতাকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গুঞ্জনও কম নয়।
ভেজালের কারবার দেশে আরও অনেক আছে। মাঝে মাঝে সেসব প্রকাশ্যে আসে। তা বলে ওষুধেও ভেজালের খবর অত্যন্ত উদ্বেগজনক! ওষুধ ব্যবসার সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত অভিজ্ঞরা মনে করেন, খদ্দের টানতে দোকানে-দোকানে ডিসকাউন্টের যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, সেটাই যাবতীয় দুর্নীতির উৎস। একই পাড়ায় কোনও ওষুধের দোকানে ছাড় মিলছে ১০ শতাংশ, কোথাও ২০, কোথাও বা ২৩ শতাংশ।
সর্বভারতীয় স্তরে নামী একটি ওষুধ বিক্রির সংস্থা আবার ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের বিজ্ঞাপনে ভরিয়ে দিচ্ছে সংবাদপত্রের পুরো পাতা। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ এতে খুব বিভ্রান্ত হচ্ছে। দুটো পয়সা বাঁচাতে গিয়ে অনেকে ওষুধের মান আর খেয়ালই রাখেন না। জলের দরে পাওয়া ওষুধের পাতা ছিঁড়তে গিয়ে ট্যাবলেটই ভেঙে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের চেষ্টায় কারও ব্লাড সুগার যেটুকু বা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল, বেশি ডিসকাউন্ট খুঁজতে গিয়ে শারীরিক সমস্যা আবার ফিরে আসছে।
অথচ সাধারণ মানুষ লোভ সামলাতে পারছেন না। পাড়ায় ওষুধের নতুন দোকান ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের ফেস্টুন লাগাচ্ছে। সে নিয়ে বাদবাকি দোকানের সঙ্গে ঝামেলা। জোরজবরদস্তি নতুন দোকান খুলতে বাধা, এলাকায় উত্তেজনা, থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ানোর ঘটনাও ঘটছে। শুনতে হাস্যকর মনে হলেও ওষুধের যেন ‘চৈত্র সেল’ শুরু হয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে সর্বভারতীয় স্তরে ওষুধের গুণমান নিয়ে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বাজারচলতি বহু ওষুধ ওই পরীক্ষায় ডাহা ফেল করেছে। তার মধ্যে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ থেকে শুরু করে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট ইত্যাদি সবরকম ওষুধ ছিল। ওষুধের গুণমান বজায় রাখা মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সরকারের। তার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য, দু’পক্ষেরই কঠোর হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে সতর্ক থাকতে হবে সাধারণ মানুষকেও।
পাড়ার মধ্যেই জাল ওষুধের কারবার, কেউ টের না পাওয়া বিপজ্জনক। জঙ্গি-নাশকতার চেয়েও বিপজ্জনক এই জাল ওষুধের কারবার। মানুষের জীবন নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলা ঠেকাতে এখনই সর্বাত্মক অভিযান জরুরি।