উত্তরবঙ্গ ব্যুরো: সরকারি নির্দেশিকা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরেও দার্জিলিং জেলায় বিভিন্ন হাসপাতাল, উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বিতর্কিত সংস্থার স্যালাইন (Saline) ব্যবহার হয়েছে। শনিবার সকালে পুনরায় নির্দেশিকা দিয়ে ওই সংস্থার তৈরি সমস্ত স্যালাইন ব্যবহার বন্ধ করতে বলা হয়েছে। সেই জায়গায় আপাতত ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান থেকে প্রয়োজনীয় স্যালাইন কিনে হাসপাতালে ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তর। তবে, রোগীর চিকিৎসায় সন্দেহজনক উপসর্গ দেখা দেওয়ায় ইসলামপুর মহকুমা হাসপাতালে আট মাস আগেই চিকিৎসকরা এই সংস্থার স্যালাইন ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন। এত বিতর্ক যে সংস্থাকে নিয়ে চোপড়ার সেই পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালস গত ১১ ডিসেম্বর কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করার নোটিশ দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও ভিতরে স্যালাইন তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে, সংস্থার তরফে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
২০১৪ সালে চোপড়া ব্লকের সোনাপুরে জাতীয় সড়কের পাশে পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালস জমি নিয়ে স্যালাইন কারখানা তৈরি করে। সেখানে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০ জন কর্মী বিভিন্ন শিফটে কাজ করেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের একাধিক রাজ্যে স্বাস্থ্য দপ্তর কয়েক বছর ধরে এই সংস্থার স্যালাইন কিনছে। এ রাজ্যে স্বাস্থ্য দপ্তর সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরে এই সংস্থার স্যালাইন কিনেছে। সেই স্যালাইন রাজ্যের সমস্ত সরকারি হাসপাতাল, মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। এখনও রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে এই সংস্থার তৈরি প্রচুর স্যালাইন মজুত রয়েছে, যেগুলির মেয়াদ ২০২৭ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত।
গত বছর ৯ ডিসেম্বর কর্ণাটক স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে ড্রাগ কন্ট্রোল জেনারেল অফ ইন্ডিয়াকে লেখা চিঠিতে জানানো হয়েছিল যে, পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালসের স্যালাইন ব্যবহার করে সেই রাজ্যে চারজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অবিলম্বে তদন্ত করে অভিযুক্ত সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেছিল কর্ণাটক স্বাস্থ্য দপ্তর। তারপরেই তদন্ত শুরু করে কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোল বিভাগ। বন্ধ করে দেওয়া হয় সোনাপুরের ওই স্যালাইন প্রস্তুতকারী কারখানা। ১১ ডিসেম্বর থেকে সেখানে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
এ বছর ৭ জানুয়ারি রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর থেকে একটি নোটিশ রাজ্যের সমস্ত জেলায় পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি স্যালাইন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফার্মা ইনপেক্স ল্যাবরেটরিজ প্রাইভেট লিমিটেড নামে নতুন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। তারা দ্রুত একই দরে স্বাস্থ্য দপ্তরকে স্যালাইন সরবরাহ করবে। অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি থেকে রাজ্যের কোনও সরকারি হাসপাতালে পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালসের স্যালাইন ব্যবহারের কথা নয়। কিন্তু তারপরেও উত্তরবঙ্গ মেডিকেলে শনিবারও বিভিন্ন অন্তর্বিভাগে এই স্যালাইন ব্যবহার হয়েছে। চিকিত্সকদের অনেকেই জানিয়েছেন, এদিন দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন অন্তর্বিভাগ এবং অপারেশন থিয়েটারে এই স্যালাইন ছিল। পরে অবশ্য সেগুলি সরিয়ে নেওয়া হয়। দার্জিলিং জেলার বিভিন্ন হাসপাতালেও শনিবার এই স্যালাইন ব্যবহার হয়েছে।
ওই সংস্থার স্যালাইন সরবরাহ করা হত এমজেএন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। মেদিনীপুরের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরই সেখানে তড়িঘড়ি ওই স্যালাইন দেওয়া বন্ধ করা হল। শনিবার নবান্ন ও স্বাস্থ্য ভবনের শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে রাজ্যের মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধিদের একটি বৈঠক হয়। এমজেএন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এমএসভিপি সৌরদীপ রায় বলেছেন, ‘আমরা আপাতত ওই সংস্থার স্যালাইন দেওয়া বন্ধ রেখেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের থেকে যা নির্দেশ আসবে সেই অনুযায়ী কাজ হবে।’
এমজেএন হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, এখানে প্রতিদিন ১০০০-১২০০ স্যালাইন প্রয়োজন। চোপড়ার যে ওষুধ কোম্পানির স্যালাইন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেই কোম্পানির ১৫৫টি স্যালাইন বর্তমানে এমজেএন মেডিকেলে রয়েছে। সেগুলিকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। যদিও হাসপাতালের আধিকারিকরা জানিয়েছেন, চোপড়ার ওই কোম্পানির তৈরি যে ব্যাচের স্যালাইন নিয়ে মেদিনীপুরের সমস্যা হয়েছে ওই ব্যাচের কোনও স্যালাইন কোচবিহারে ছিল না। ফলে এখানে আশঙ্কার কিছু নেই।
আলিপুরদুয়ার জেলায় এই আরএল স্যালাইন দীর্ঘদিন থেকে রোগীদের দেওয়া হচ্ছে না বলেই জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। কয়েক মাস আগে ফালাকাটার এক প্রসূতিকে এই স্যালাইন দেওয়ার পর সমস্যা হয়। এরপর থেকে এই স্যালাইন ব্যবহার করছে না হাসপাতালগুলি।
জলপাইগুড়ি জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ অসীম হালদার বলেন, ‘আরএল স্যালাইন আমরা ইতিমধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছি। তার জায়গায় ন্যাযমূল্যের ওষুধের দোকান থেকে কিনে নিতে বলা হয়েছে। এছাড়াও আমরা অন্য কোম্পানির আরএল-এর জন্য অর্ডার দিয়েছি। আশা করছি দু-একদিনের মধ্যেই চলে আসবে। এই মুহূর্তে এই স্যালাইনের জন্য অসুবিধা হচ্ছে না।
শনিবার ভোররাত থেকে দুপুর পর্যন্ত রায়গঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে প্রায় ২০০ জন রোগীর শরীরে এই স্যালাইন ব্যবহার করা হয়েছে। হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগ, প্রসূতি বিভাগ, সার্জিক্যাল বিভাগ সহ একাধিক বিভাগে সেই একই কালো তালিকাভুক্ত স্যালাইন চালানো হয়েছিল। এমন ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্কিত রোগীর পরিবার ও পরিজনরা। শনিবার সকালেও হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, কালো তালিকাভুক্ত স্যালাইন রোগীর দেহে দেওয়া হচ্ছে রায়গঞ্জ হাসপাতালে।
ইসলামপুর মহকুমা হাসপাতালে প্রায় আট মাস আগেই ওই সংস্থার স্যালাইন, বিশেষ করে ‘আরএল’ ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালের চিকিৎসক অমিতাভ কুণ্ডু বলেন, ‘এই স্যালাইন দিলে রোগীদের খিঁচুনি দিয়ে জ্বর আসছিল। আমরা বিষয়টি বুঝতে পেরে ওই স্যালাইনের ব্যবহার বন্ধ করেছিলাম।’ হাসপাতালের সহকারী সুপার সন্দীপন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘চিকিৎসকরা ওই সংস্থার আরএল স্যালাইন ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করায় জেলায় কথা বলে আমরা আগেই এর ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছি।’
প্রশ্ন উঠেছে, ৭ জানুয়ারি নিষিদ্ধ ঘোষণা হওয়া স্যালাইন কীভাবে উত্তরবঙ্গে একাধিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যবহার হল? দার্জিলিংয়ের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তুলসী প্রামাণিক বলেন, ‘শনিবার সকালেই সব হাসপাতালে নির্দেশ পাঠিয়ে ওই স্যালাইনের ব্যবহার বন্ধ করতে বলা হয়েছে। আপাতত কাজ চালানোর জন্য হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান থেকে স্যালাইন কিনতে বলা হয়েছে। তার জন্য যা খরচ হবে সেটা আমরা দিয়ে দেব।’ তবে, ৭ তারিখের নোটিশ নিয়ে মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কিছু বলতে চাননি। অন্য হাসপাতালগুলিতেও স্বাস্থ্যকর্তারা স্পষ্ট করেননি শেষ কবে চোপড়ার ওই কোম্পানির স্যালাইন ব্যবহার করা হয়েছে।
রায়গঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত এমএসভিপি বিদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট স্যালাইন বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’