রাজেশ দাস, গোপালপুর: রুই, কাতল, মৃগেল, ইলিশ, বোরোলি, পুঁটি। এই দুনিয়ায় হাজারো রকমের মাছ থাকলেও সেই সমস্ত প্রজাতির বিষয়ে সাধারণ মানুষের জ্ঞান কিন্তু মোটামুটিভাবে সীমিতই। এ নিয়ে কারও মনে যদি কোনও আক্ষেপ থাকে তবে মাথাভাঙ্গা–১ (Mathabhanga) ব্লকে গোপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ভেলাকোপা গ্রামে লক্ষ্মীকান্ত বর্মনের বাড়ি যাওয়া যেতে পারে। সেখানে গেলে রুই, কাতল, মৃগেল তো বটেই আরও ১৫৩ প্রজাতির মাছের দেখা মিলবে। নানা আকারের কাচের জারে সংরক্ষিত অবস্থায়। গোটা বাড়িটাকেই তিনি মাছের মিউজিয়াম (Fish Museum) বানিয়ে ফেলেছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় বলতে যে সমস্ত মাছ নিয়ে তাঁর এই মিউজিয়াম, সবই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন নদীতে মেলে। লক্ষ্মীকান্তর ইচ্ছে একটাই, নতুন প্রজন্ম বেশি করে মাছ চিনুক। তাঁর এই ইচ্ছেয় অবশ্য অনেকেই সাড়া দিচ্ছেন। লক্ষ্মীকান্তর সাধের মাছ মিউজিয়াম দেখতে আজকাল তাঁর বাড়িতে বেশ ভিড়।
মাছের মিউজায়াম? শুনে খটকা লাগছে? দেশে কিন্তু এমন অনেক মিউজিয়াম আছে। কলকাতা জাদুঘরে জুলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (জেডএসআই) এমন একটি ফিশ মিউজিয়াম আছে। লখনউতে জাতীয় মাছ জাদুঘর রয়েছে। দেশে এমন আরও কয়েকটি নজির থাকলেও উত্তরবঙ্গে সম্ভবত নেই। একক উদ্যোগে তো বটেই। আর এখানেই লক্ষ্মীকান্ত কামাল করেছেন। যেভাবে মাছই আজকাল তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, এলাকায় ‘মাছপাগল’ হিসেবে পরিচিতি পেতে তাঁর দেরি হয়নি।
গোড়া থেকেই তাঁর অবশ্য এহেন মৎস্যপ্রীতি ছিল না। একসময় ধান, পাট, তামাকের চাষ করতেন। বছর ৪০ আগে মাথাভাঙ্গার দুয়াইশুয়াই গ্রামে গিয়ে দুটি পুকুর থেকে মৎস্যজীবীদের মাছ ধরতে দেখে তাঁর ‘মীনমুখী’ হওয়া। মাছ বিক্রির সুবাদেও যে বেশ লাভ করা যায় সেটা উপলব্ধি করার পর নিজ এলাকায় ফিরে এসে মাছ চাষের সিদ্ধান্ত। বাড়ির পাশেই দুটো ফাঁকা জলাশয়ে মাছ চাষ শুরু। আজকাল প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে তাঁর সেই চাষের সুফল ছড়িয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই পুকুরে গিয়ে মাছ চাষের দিকে কড়া নজর দেওয়া। তাঁর চাষ করা রুই, কাতল, মৃগেল, মাগুর, শিঙি, বোরোলি সহ বহু জাতের মাছ কোচবিহার জেলা তো বটেই, ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি সহ উত্তরবঙ্গের নানা প্রান্তের বাজারগুলিতে যায়। মাছ নিয়ে ব্যবসা করে সফল শিল্পপতি হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি।
লক্ষ্মীকান্ত সেই সাফল্যে মজেছেন আর মাছ সংরক্ষণে ডুবেছেন, ‘উত্তরবঙ্গ মাছের খনি। অথচ আক্ষেপের বিষয় বলতে আমাদের মধ্যে অনেকেরই এখানকার মাছের বিষয়ে সেভাবে কোনও ধারণা নেই। সেকারণে আমার এই উদ্যোগ।’ মাছ চাষের সুবাদে বেশ কয়েকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন। মাছ চাষ করে কীভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায় সে বিষয়ে প্রৌঢ় মানুষটি অন্যদের স্বেচ্ছায় সাহায্য করেন। তাঁর কাছে মাছ চাষ শিখে শ্যামল বর্মন, সুলতান মিয়াঁর মতো অনেকেই আজ স্বাবলম্বী। লক্ষ্মীকান্তের এহেন উদ্যোগকে মাথাভাঙ্গা-১ ব্লক মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক অঙ্কিত শর্মার মতো অনেকেই প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। গোপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধানের নামও লক্ষীকান্ত বর্মন। এক লক্ষ্মীকান্ত আরেক লক্ষ্মীকান্তর প্রশংসা শুনে খুবই লজ্জায় পড়েন। তবে তিনি নিজের লক্ষ্য থেকে সরতে রাজি নন। বরং, সবার মধ্যে মৎস্যপ্রীতি বৃদ্ধিতে মাছ চাষের জন্য একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র খোলার পরিকল্পনায় আজকাল বেশি করে ডুব দিয়েছেন।