মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

রায়গঞ্জে মিষ্টির অন্য ভুবনে নয়া বাণিজ্যকরণ

শেষ আপডেট:

  • দীপঙ্কর দাশগুপ্ত

বরোদা থেকে লেখা অলকানন্দাদির একটা চিঠি পেলাম। তাতে তিনি লিখছেন, ‘‘হঠাৎ মনে পড়ল আমার এক মাসি একটি মিষ্টি বানাতেন, নাম, ‘পরচিত্তহরণ’। ছানার মিষ্টি। সম্ভবত ঢাকার।’’ অলকানন্দা প্যাটেল। রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর আইজি প্যাটেলের স্ত্রী। আর অমর্ত্য সেন এবং রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক মিত্রের অর্থনীতির শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত অধ্যাপক অমিয়কুমার দাশগুপ্তের কন্যা। অলকানন্দাদির সঙ্গে আমার আলাপ কীভাবে সে অন্য প্রসঙ্গ। তবে ‘পরচিত্তহরণ’ মিষ্টির নামেই যে বাজিমাত। ‘প্রাণহরা’র নামের সঙ্গে মিল রয়েছে। দুটি মিষ্টির নামের পিছনে অন্তর্নিহিত দর্শনটি চমৎকার। খাঁটি উপকরণ আর কারিগরের হাতের গুণে সেই মিষ্টির অনন্য স্বাদ। অপরকে খাইয়ে তৃপ্তি দেওয়া যার আসল উদ্দেশ্য।

আজকাল কোথাও মিষ্টি মুখে দিলে তৃপ্তিতে কি চোখ বুজে আসে? পরচিত্তহরণ শব্দটি কি আজ আর কারও মনে উঠে আসতে পারে? যে কোনও মিষ্টির আসল উপাদান দুধ ও ছানা। সেই দুধই বা কই, ছানাই বা কই! ক্রেতাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য, ভালো ছানা ও তার উপযুক্ত পরিমাণের খামতি ঢাকার জন্য তাই চকোলেট ও অন্যান্য ফ্লেভারড সন্দেশের ছলচাতুরি। ভালো ছানার উৎকৃষ্ট রসগোল্লা, নরম পাকের সন্দেশ, কাঁচাগোল্লা, সুস্বাদু দই ইত্যাদি বেচতে গেলে আর পরতায় পোষায় না। তাই হালের বাজার দখল করেছে বেকড রসগোল্লা, বেকড মিহিদানা, বেকড সন্দেশ কিংবা বেকড দই। আধুনিক প্রজন্মের যারা খাঁটি জিনিসের আসল স্বাদের সঙ্গে তেমন পরিচিত নয়, তাদের মন সহজেই জয় করে নিচ্ছে এমন সব জগাখিচুড়ি মিষ্টি। তাতে ঐতিহ্য জলাঞ্জলি গেলেই বা কার কী!

মনে পড়ে যায় লীলা মজুমদারের সেই গল্পের কথা– বাড়িতে গয়লানির দিয়ে যাওয়া ‘লালচে সুগন্ধি দুধ’ যা পড়ন্ত আঁচে বসিয়ে রাখলে ‘আধ ইঞ্চি পুরু সর পড়ে, সোনালি রঙ, তাতে চাঁদের গায়ের মতো ফুটফুট দাগ। সেই সর তুলে মধ্যিখানে কাশীর বাটা চিনি ছড়িয়ে ভাঁজ করে রাখেন অহিদিদি। সেই সরটি রোজ গোল টইটুম্বুর হয়ে থাকে।’ সেই দুধের ছানা ও তা থেকে তৈরি সন্দেশ রসগোল্লার স্বাদ যে কেমন হবে তা কি আর বলে দিতে হয়! একটা সময় বাংলার গ্রামের ঘরে ঘরে থাকত গোরু। গোরুর দুধের ছানা থেকে যেমন নানান ধরনের মিষ্টি তৈরি হত, দুধের সর থেকে মাখন তুলে তৈরি হত ঘি। এছাড়া গ্রামের গোয়ালপাড়া থেকে এক টাকায় ষোলো সের দুধ পাওয়া যেত। গোয়ালাকে দশ-পাঁচ টাকা আগাম দিলে তো টাকায় আধমন দরেও দুধ মিলত। গোরুর দুধ যাতে ঘন হয় আর দুধের পরিমাণ যাতে বাড়ে সেজন্যে তখন কোনও হরমোন ইনজেকশন দেওয়া হত না, বরং সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে, প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে গোরুকে জাবনা দেওয়া হত ভুট্টার শিষের বজরা ঘাস, জল, ভাতের মাড়, খেসারির ডালে মেশানো কুচানো খড়-বিচালি, শাকসবজির অংশ। দুধের সেই প্রাচুর্যের যুগে ভেজালের রীতি ছিল না। দুধের মান ঠিক রাখতে গোরুর পরিচর্যাতেও ছিল সমান গুরুত্ব। গো-ধন নিছক কথার কথা ছিল না। আর তাই উৎকৃষ্ট মিষ্টান্নেরও অভাব ছিল না। সেকালের স্মৃতিকথায় মিষ্টি প্রসঙ্গে মুর্শিদাবাদের সুন্দর এক সমাজচিত্রের হদিস মেলে—‘কেউ নেমন্তন্ন বাড়ি থেকে পেটপুরে খেয়ে ফিরছেন, যদি তাঁকে জিজ্ঞেস করো, কী রকম খাওয়ালে? তিনি পরম উৎসাহে বলবেন– সন্দেশই ছিল চার রকম : কাঁচাগোল্লা, রসগোল্লা, বুঁদিয়া আর জিলিপি। আমাদের গ্রামাঞ্চলে মিষ্টান্ন মানেই সন্দেশ– পান্তুয়া, গজা, মিহিদানা, খাজা, মন্ডা– সবই সন্দেশ।

সেই আমল আর নেই। ভালো মিষ্টির যুগ অবলুপ্ত। ভেজাল, চালাকি আর নিম্নমানের মিষ্টিতে অভ্যস্ত অবসন্নতার মাঝে আচমকা যদি কোনও মিষ্টির স্বাদ হঠাৎই বিরাট চমকে দেয়! ঠিক সেরকমই অভিজ্ঞতা হয়েছিল গত বছর বীজ উৎসব ও জৈব কৃষিমেলা উপলক্ষ্যে রায়গঞ্জে গিয়ে। এক কালে রায়গঞ্জে বিখ্যাত ছিল মোহনবাটীর অরুণা সুইটসের কানসাট ও কালাকাঁদ, মিলনীর মিষ্টি দই কিংবা শিলিগুড়ির মোড়ের মিতালি সুইটসের ছানার পায়েস ও কালাকাঁদ। এখন সেইসব গরিমা আর নেই। কোনও দোকান নয়, খবর পেয়েছিলাম রায়গঞ্জের সেরা মিষ্টির ঠিকানা হল কুলিক নদীর ওপারে সুভাষগঞ্জের সেতু পেরিয়ে ঘোষপাড়া। তাই টোটো নিয়ে হাজির হয়েছিলাম সেখানে। আমার সঙ্গে ছিলেন বীজ উৎসবে অংশগ্রহণকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও খাদ্য গবেষক বন্ধু সংহিতা দাশগুপ্ত। ফোনে আগেই কথা বলা ছিল। তাই পাড়ার মধ্যে ষষ্ঠীদের দোতলা বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি।

আমরা গিয়েছিলাম সন্ধ্যার ঠিক আগে। গেট দিয়ে ঢুকেই ঝকঝকে তকতকে বিরাট উঠোন। সামনের গোয়ালে গোরু। আর বাঁ দিকে বাড়ির লাগোয়া শেডের নীচে মিষ্টির কারখানা। সেখানে তখন বিরাট বিরাট কড়ায় দুধ জ্বাল দেওয়া চলছে। একটা নৌকায় সদ্য তৈরি পান্তুয়া। আর একটা উনানে পাতলা রসে ফেলা হচ্ছে রসগোল্লা। এই যে চোখের সামনে দেখছি মিষ্টি তৈরি হচ্ছে, পাশে মজুত করে রাখা আছে দুধ ও ছানা, কিন্তু কোথাও এতটুকু অপরিচ্ছন্নতা নেই। ষষ্ঠী বলছিল, ওদের তৈরি কালাকাঁদ, প্যাঁড়া রোজ নানা মন্দিরে যায়, অনেক বাড়িতেও রোজের পুজোয় লাগে। তাই বাবা-মায়ের নির্দেশ মেনে দুধ জ্বাল দেওয়া থেকে শুরু করে ছানা কাটানো, মিষ্টি তৈরি সবই ওরা করে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে, ভক্তিভরে।

 ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাবনা থেকে সীমান্তের এপারে চলে এসেছিলেন সোমেন ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী রঞ্জু। পূর্ববঙ্গে তিনি দই-মিষ্টির ব্যবসা করতেন। টালমাটাল সময়ে নিজস্ব ভিটেমাটি ছেড়ে চলে এসে রায়গঞ্জে থিতু হতে কেটে গেল অনেকগুলি বছর। তারপরে নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে সোমেনবাবু নতুন উদ্যমে আবার দই-মিষ্টির ব্যবসা শুরু করলেন প্রায় ১৭-১৮ বছর হল। ঘোষপাড়ায় চেনা গোয়ালাদের কাছ থেকে গোরুর খাঁটি দুধ সংগ্রহ করে স্বামী-স্ত্রী মিলে মিষ্টি বানিয়ে সাইকেলে করে কাছে-দূরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মিষ্টি বিক্রি করতে শুরু করেন সোমেনবাবু। তখন খদ্দের ছিল মোটামুটি ৫০-১০০ বাড়ি। ভালো মিষ্টির সুবাদে সুনাম ছড়িয়েছে চারিদিকে। তাই আজ তাঁদের নিয়মিত বাঁধা বাড়ির সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। দুর্গাপুজো বা অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানের সময় বিক্রিবাটা আরও বেশি।
ঘোষ দম্পতির এই পারিবারিক ব্যবসায় ক্রমে যোগ দিয়েছে তাঁদের দুই পুত্র সুব্রত ও ষষ্ঠী। বড় ভাই সুব্রত ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলোয় চৌকশ। জেলা ও রাজ্য স্তরে অ্যাথলেটিক মিট ও হার্ডলস রেসে কয়েক বছর ধরে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান অধিকার করে পুরস্কার পেয়েছে। বছর দশেক আগে সিএমপি রেজিমেন্টে শালুগাড়ায় চাকরিও পেয়েছিল। কিন্তু সব ছেড়ে আবার ফিরেছে পারিবারিক ব্যবসায়।

রায়গঞ্জের উকিলপাড়া, মিলনপাড়া, বীরনগর, রবীন্দ্রপল্লি, বোগ্রাম ছাড়াও কালিয়াগঞ্জ, কিশনগঞ্জ, ইসলামপুর ছাড়িয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে ঘোষ পরিবারের তৈরি রসগোল্লা, ছানার জিলিপি, নরম পাকের সন্দেশ, গোলাপজাম, ছানাবড়া, মালাই চমচম, ল্যাংচা, লাড্ডু, প্যাঁড়া ইত্যাদি। পিস প্রতি কোনও মিষ্টির দামই ১০-১৩ টাকার বেশি নয়। দোতলার ঘরে বসে এই কথাবার্তার মধ্যেই সোমেনবাবুর স্ত্রী ও পুত্রবধূ বোন চায়নার প্লেট ও বাটিতে নিয়ে এলেন মিষ্টি দই, ছানার পায়েস, কালাকাঁদ, রসগোল্লা আর ছানার জিলিপি। কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি!

এমন মিষ্টি বা ছানার পায়েস ও দইয়ের স্বাদ যে আজকাল সচরাচর কোথাও পাওয়া যায় না তা নিশ্চিত করে বলতে পারি। ছানার পায়েস ওঁরা বিক্রি করেন ৪০০ টাকা কেজি, মিষ্টি দই ৩০০ টাকা কেজি। আবার এর সঙ্গে আগেকার দিনে বিজয়া দশমীর সময় ঘরে বানানো কুচো নিমকি, খুরমা, তিনকোনা নিমকি, মিহিদানা, নারকেল নাড়ুও নিয়মিত তৈরি করেন ওঁরা। সে সবের সুস্বাদও কিছু কিছু পেলাম আমরা আর অবশ্যই মোহিত হলাম। সোমেনবাবু বলছিলেন, ভালো দুধের জোগান নিশ্চিত করতে বাজার চলতি দামের চেয়ে বেশি দামে তাঁরা দুধ সংগ্রহ করেন। পাঁচ কেজি দুধে এক কেজি ছানা হয়। ছানার কেজি ২৫০ টাকা। এখন গড়ে প্রতিদিন তাঁদের এক কুইন্টালের বেশি ছানার কাজ হয়। পুজোর সময় পরিমাণ হয়ে যায় দ্বিগুণ। দই তৈরি হয় ৪৫-৫০ কেজি। আর ছানার পায়েস প্রায় ২০ কেজি। তবে ইদানীং তাঁরা এক অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছেন। ওই এলাকায় আমূল দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র খুলেছে। তারা দুধে মাঠার পরিমাণ পরীক্ষা করে লিটারে ৫০-৫২ টাকা দামও দিচ্ছে। কাজেই আমূলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুধের জোগান অব্যাহত রেখে নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা চালানোর ব্যাপারে তাঁরা কিছুটা দুশ্চিন্তায়।

বাংলার মিষ্টান্ন শিল্পের সার্বিক অবক্ষয়ের যুগে খাঁটি মিষ্টির ঐতিহ্য বজায় রাখতে উত্তরবঙ্গের এই ক্ষুদ্র পারিবারিক উদ্যোগ কি রাজ্যবাসীর এতটুকু নজর কাড়বে না? তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, ইতিহাসবিদ জয়ন্ত সেনগুপ্ত সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, দুর্গাপুজো ইউনেসকোর হেরিটেজ তকমা পেয়েছে, ধ্রুপদি ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা। তাঁর প্রস্তাব এবারে বাংলার রসগোল্লা, সন্দেশের জন্যেও হেরিটেজ ট্যাগ আদায়ে ইউনেসকোর কাছে দরবার করা উচিত। আর সেইজন্যেই আরও দরকার রাজ্যের নানা প্রান্তে নির্ভেজাল, খাঁটি মিষ্টির হদিস করে কুশলী কারিগরদের যথাযথ মর্যাদার আসনে বসানো।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহদেবতার কথা

পূর্বা সেনগুপ্ত   তখন বৈষ্ণবদের ভক্তির রসে আপ্লুত, তন্ত্রের আচারে...

দীপার পাত্র

জয়ন্ত দে             দ্যুতিমানকে দুশ্চরিত্র কোন শালা বলে। দ্যুতিমান ভগবান...

শাপলা

মনোনীতা চক্রবর্তী             আরও একটা জন্মদিনের দিকে এগোচ্ছে  স্বচ্ছতোয়া। আরও...

১ আনমনা   সুব্রতা ঘোষ রায়    বসন্ত এসেছিল পলাশের ডালে, আনমনা মেয়ে তার কোন ব‍্যথা...