শুভ সরকার ও সৌভিক সেন: স্কুটারে টিউশন থেকে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন কৃষ্ণেন্দু সরকার। শিলিগুড়ি শহরের রথখোলা এলাকায় যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হল, তখন রাত প্রায় বারোটা। এত রাতে! কারণ, ছেলেকে পড়ানোর ভার যে শিক্ষককে ভরসা করে দিয়েছেন, তিনি এত রাতের ব্যাচেই সময় দিয়েছেন। অগত্যা।
মোদ্দা কথা হল এই ভরসাটা। গত পাঁচ-সাত বছরে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকাতেও সন্তানের কেরিয়ারের জন্য এই ভরসার জায়গাটা আস্তে আস্তে স্কুল থেকে সরে প্রাইভেট শিক্ষকদের দিকে চলে গিয়েছে। আজ থেকে বছর ছয়েক আগেও সকাল সকাল নাকে-মুখে ভাত গুঁজে পড়ুয়াদের যে দৌড়টা ছিল স্কুলের উদ্দেশে, এখন সেটাই হয়ে গিয়েছে গৃহশিক্ষকের বাড়ির দিকে। তবে স্কুলের মতো তার নির্দিষ্ট কোনও সময় নেই। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা, যে কোনও সময়ই হতে পারে।
কথা হচ্ছিল শিলিগুড়ির একটি পুরোনো ও নামকরা গার্লস স্কুলের ছাত্রী অঙ্কিতা রায়ের সঙ্গে। মাধ্যমিকে ভালো ফল করা অঙ্কিতার প্রতিটা বিষয়ে গৃহশিক্ষক ছিলেন। একাদশ শ্রেণিতে ওঠার পরেও প্রতি বিষয়ে তার গৃহশিক্ষক রয়েছে। কেন? স্কুলের পড়াশোনা কি যথেষ্ট নয়? ‘না নয়’, সাফ কথা অঙ্কিতার। তার যুক্তি, ক্লাসের নির্ধারিত সময়ে সব পড়া হয় না। পড়া বুঝতে সমস্যা হলে স্কুলের দিদিদের কাছে গেলে তাঁরা বাড়তি সময় দেন না। তাই অঙ্কিতার টোটোচালক বাবা স্বল্প উপার্জনের মধ্যেই আর কিছু না হোক, মেয়ের গৃহশিক্ষকদের মাইনে জোগাড় করেন প্রত্যেক মাসে।
অঙ্কিতা একা নয়। দিনহাটার একটি নামকরা স্কুলের কৃতী ছাত্রীর মা অসুস্থ অনেকদিন। বাবার ছোট দশকর্মা ভাণ্ডার রয়েছে। মা সংসারের খরচ জোগাতে বিড়ি বাঁধেন। পুজোর সময় দুই মেয়েকে জামা কিনে দিলেও দম্পতি নিজের জন্য কিছু কেনেন না। এমনকি মা নিজের অসুখে বড় চিকিৎসকের কাছে যান না ভিজিট বেশি বলে। কিন্তু ওই ছাত্রীর প্রাইভেট টিউটরের সংখ্যা ছয়। আরেক ছাত্রী আলিপুরদুয়ার জেলার কামাখ্যাগুড়ির বাসিন্দা। হাইস্কুলের পড়ুয়া। বাবার ফাস্ট ফুডের দোকান। এবার উচ্চমাধ্যমিকে ৪৫৬ নম্বর পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সে পাঁচটি বিষয় পাঁচজন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ত।
কথা হচ্ছিল কোচবিহারের শুভেন্দু কর্মকারের সঙ্গে। মাঝবয়সি শুভেন্দুর মেয়েরও একাধিক গৃহশিক্ষক রয়েছেন। শুভেন্দু বলছিলেন, ‘আমাদের ছোটবেলায় যারা একটু অবস্থাপন্ন, তাদের বাবা-মায়েরাই শুধু সন্তানকে গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠাতেন। আমরা তো স্কুলের ক্লাস করে করেই পড়াশোনা করেছি।’
তাহলে ছবিটা বদলে গেল কেন? গৃহশিক্ষকতার আবার ভাগ রয়েছে। আইনে মানা হলেও বহু সরকারি স্কুলের শিক্ষক প্রাইভেটে পড়ান। আবার গৃহশিক্ষকদের একটা বড় অংশ কোনও স্কুলের সঙ্গে যুক্ত নন। কেবল গৃহশিক্ষক। কথা বলা গেল ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রাইভেট টিউটর ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি তথা সংগঠনের আলিপুরদুয়ার জেলা সভাপতি সুব্রত রায়ের সঙ্গে। তাঁর মতে, ‘স্কুলে দিন-দিন পড়াশোনায় ঘাটতি হচ্ছে। কোনও লেসন প্ল্যান থাকছে না। শিক্ষকরা যেমন খুশি পড়িয়ে চলে যাচ্ছেন। একপ্রকার উদাসীনতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছেন শিক্ষকদের বড় অংশ।’
অথচ সেই সরকারি শিক্ষকদের বাড়িতেই ভিড় উপচে পড়ছে। গাজোলের অবারিত হক রোদ্দুরের মতো পড়ুয়ারা আবার বলছে, স্যর বা ম্যাডাম টিউশনে ভালোই পড়ান। তাই স্কুলের যে স্যর টিউশনে ভালো পড়ান, তাঁর ব্যাচে পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ক্লাসরুমের চেহারা নিচ্ছে। সেই ভিড়ের মধ্যে প্রত্যেক পড়ুয়ার কাছে পৌঁছানো কতটা সম্ভব, তার ঠিক নেই। বলছে সেই অবারিতরাই। তবুও কোচিংয়ে ভিড় কমছে না।
পড়ুয়াদের এই টিউশন-প্রবণতা মানছেন রায়গঞ্জ করোনেশন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কালীচরণ সাহা। কেন এই অবস্থা? ‘স্কুলে পড়াশোনা ঠিকমতোই হয়। আসলে স্কুলের প্রতি পড়ুয়াদের আগ্রহটা হারিয়ে গিয়েছে। কেন এ রকম হচ্ছে জানি না। কারণ খোঁজা জরুরি’, বলছেন কালীচরণ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই প্রবণতার কারণ খুঁজছে। তবে ভরপেট খাওয়া জুটুক না জুটুক, সন্তানের দুধেভাতে থাকার স্বপ্নে বুঁদ বাবা-মা খুঁজছেন ভালো থেকে আরও ভালো প্রাইভেট টিউটর।