শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: জমি কেলেঙ্কারি ফাঁস হতেই চাপে পরে লোকদেখানো অভিযান চালিয়েছে প্রশাসন (Administration)। কারও বাগানবাড়ির সিঁড়ি, কোনও রিসর্টের সীমানা প্রাচীরের কিছুটা অংশ ভেঙ্গেই দায় সেরেছে প্রশাসন। কোথাওই বুলডোজারের ছোঁয়া লাগেনি মূল নির্মাণ বা বহুতলে। গজলডোবায় (Gajoldoba) সরকারি জমি দখল (Government land grab) করে তৈরি সেইসব রিসর্ট, বাগানবাড়িতে এখনও বহাল তবিয়তেই রয়েছেন দখলদাররা। বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে কেন গড়িমসি করছে প্রশাসন সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।
বেআইনি রিসর্ট, বাগানবাড়ি বা অন্য দখলদারদের কায়দা করে সুবিধা করে দিতেই কি তাহলে তলে তলে গোপন কোনও পরিকল্পনা হচ্ছে? গজলডোবা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ভাইস চেয়ারম্যান খগেশ্বর রায়ের বক্তব্য, ‘প্রশাসন তাদের মত করে পদক্ষেপ করবে। এটা সম্পূর্ণ প্রশাসনের ব্যাপার।’
জলপাইগুড়ির সদর মহকুমাশাসক তমজিৎ চক্রবর্তী, রাজগঞ্জের ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক সুখেন রায় কেউই কোনও কথা বলতে চাননি। গজলডোবা শুনেই এড়িয়ে গিয়েছেন জেলা প্রশাসনের বড় কর্তারাও। সূত্রের খবর, কয়েকদিন আগেই কলকাতার এক অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রীর কাছে দরবার করেছিলেন বেআইনি রিসর্ট মালিক ও জমি মাফিয়াদের কয়েকজন। সেই মন্ত্রী কলকাঠি নাড়াতেই থামকে গিয়েছে বুলডোজার।
দুদিন আগেই গজলডোবায় দ্বিতীয় দফায় বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে বুলডোজার নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন প্রশাসনের কর্তারা। কয়েকটি রিসর্ট, বাগানবাড়ি সহ দখল করে রাখা আঠারোটি সরকারি জমির সীমানা প্রাচীরের খানিকটা অংশ ভেঙ্গে দেওয়া হয়। তবে কোনও জমিই নিজেদের হেফাজতে নেয়নি প্রশাসন। মিলনপল্লী থানার কাছেই রয়েছে শিলিগুড়ি পুরনিগমের প্রয়াত তৃণমূল কাউন্সিলার কৃষ্ণ পালের রিসর্ট। সরকারি জমিতে তৈরি সেই রিসর্টের গেট সহ সীমানা প্রাচীরের খানিকটা ভেঙ্গে দিলেও এদিন খোলাই ছিল রিসর্ট। রিসর্টে বাইক নিয়ে আনাগোনা করতে দেখা যায় কয়েকজন যুবক-যুবতিকে। রিসর্টের রিসেপশনে হাতে তিনটি ফোন নিয়ে বসে ছিলেন জনৈক উত্তম সরকার। নিজেকে রিসর্টের কর্মী পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের মালিক বলেছে খোলা থাকবে। তাই খোলা রেখেছি।’
কৃষ্ণ পালের রিসর্টের উল্টোদিকেই বেশ কয়েকবিঘা জমির উপর থাকা একটি বিলাসবহুল বাগানবাড়ির সদর দরজাও ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। সেই বাগানবাড়িতেই রয়েছেন কেয়রটেকার ভজনচন্দ্র দাস। তালমার বাহাদুর কলোনির বাসিন্দা ভজনের কথা, ‘মালিকতো প্রায় প্রতিদিনই আসছেন। সবই ঠিক আছে। শুধু গেটটা ভেঙ্গে দেওয়ায় রাতে পুকুরের মাছ, খামারের মুরগি চুরির ভয় থাকছে।’ ভজনের বক্তব্য ওই বাগানবাড়ির মালিক শিলিগুড়ির বাসিন্দা জনৈক সুকুমার দাস। তবে সুকুমারের দাবি তিনি নন, আসল মালিক শিলিগুড়ির শক্তিগড়ের বাসিন্দা দীপালি পাল। তাঁরা যে সরকারি জমি দখল করেছেন তা স্বীকার করে নিয়েছেন সুকুমার। তাঁর বক্তব্য, ‘ওই এলাকায় কারও জমির রেজিস্ট্রেশন নেই। সবাই দখল করেছে।’ সূত্রের খবর, ওই বিলাসবহুল রিসর্ট তৈরির পেছনে শিলিগুড়ি এক প্রভাবশালী নেতার যোগ রয়েছে।
তৃণমূল ঘনিষ্ঠ শিলিগুড়ি বিধানরোড ব্যবসায়ী সমিতির নেতা সুব্রত সাহার রিসর্টে কার্যত বুড়ি ছোঁয়া দিয়েছে বুলডোজার। ওই এলাকার সবথেকে বিলাসবহুল রিসর্ট তৈরি করছে সুব্রত। রিসর্টের গেটে থাকা একটি সুদৃশ্য কংক্রিটের হাতি এবং সীমানা প্রাচীরের সামান্য অংশই ভাঙ্গা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, ওইটুকু ভাঙ্গা না ভাঙ্গা কার্যত সমান। এদিন ভেতর থেকে রিসর্টের গেট বন্ধ ছিল। আর ভেতরে বেশকিছু লোকজনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শিলিগুড়ির বেশ কয়েকজন যুবক রিসর্টে নিয়মিত থাকছেন।
থানা থেকে কিছুটা এগোলেই দুধিয়া এলাকা। সেখানে আটটি সীমানা প্রাচীর ভাঙ্গা হয়েছে। ওই এলাকাতেই প্রায় আট বিঘা সরকারি জমি ঘিরে নিয়ে দোতলা ভবন তৈরি করেছেন জলপাইগুড়ির কয়েকজন ঠিকাদার। সেই জমিতে ডাঁই করে রাখা হয়েছে বালি, বজরি সহ নানা নির্মাণ সামগ্রী এবং যন্ত্রাংশ। সেই ভবনের সামান্য অংশ এবং গেট ভাঙ্গা হয়েছে। তবে সেই ভবনে বহাল তবিয়তেই রয়েছেন ঠিকাদারের কেয়ারটেকার ও অন্য কর্মীরা। ওই সম্পত্তি দেখভাল করেন খোকন মজুমদার।
এদিন দুপুরে গিয়ে দেখা গেল অন্য কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে খেয়েদেয়ে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন তিনি। ডেকে তুলে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই তাঁর বক্তব্য, ‘কয়েকদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তাই সম্পত্তি দেখভাল করছি।’ ঠিকাদারি সংস্থার অন্যতম পার্টনার চন্দ্র কর্মকারের কথা, ‘না বুঝেই বছর তিনেক আগে জমিটি কিনেছিলাম। অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। স্থানীয় এলাকায় সরকারি রাস্তা তৈরির কাজের বরাত পেয়ে সেখানে কিছু সামগ্রী রেখেছিলাম। প্রশাসনের সিদ্ধান্ত মেনেই কাজ করব।’