শুভঙ্কর চক্রবর্তী, গজলডোবা: প্রায় দশ বিঘা জমির উপর পাথর দিয়ে পাড় বাঁধানো বিশাল জলাশয়। সুইমিং পুলের আদলে তাতে বসানো হয়েছে জল ভরা ও বের করার অত্যাধুনিক পাইপলাইন। পুকুরের চারপাশে রয়েছে ফল ও সবজি বাগান। তার পাশেই সুদৃশ্য কাঠের দোতলা বাড়ি। আর পুকুরের ঘাটে বাঁধা রয়েছে শিকারার আদলে তৈরি রঙিন নৌকা। এটাই গজলডোবায় (Gajoldoba) সরকারি জমি দখল করে শিলিগুড়ি (Siligui) পুরনিগমের তৃণমূল কাউন্সিলার (TMC Councillor) রঞ্জন শীলশর্মার (Ranjan Shil Sharma) তৈরি করা বাগানবাড়ির ছবি। স্থানীয়রা বলছেন, মাঝেমধ্যেই এই বাগানবাড়িতে প্রমোদ আসর বসাতেন রঞ্জন। সেখানে ভিড় জমাতেন অনেক তৃণমূল নেতাই। আর রঙিন নৌকায় চড়ে পুকুরে ঘুরে বেড়ানোর শখ রয়েছে বিতর্কিত ওই কাউন্সিলারের।
দিন দুয়েক আগে সেই সম্পত্তি ‘সিল’ করেছিলেন প্রশাসনের কর্তারা। পুলিশের বড় কর্তাদের সঙ্গে রাজগঞ্জের (Rajganj) ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক দাঁড়িয়ে থেকে ওই জমিতে সরকারি বোর্ড লাগিয়েছিলেন। কিন্তু লোকদেখানো অভিযান করে বোর্ড লাগানোই সার। সিল করা ওই সম্পত্তি এখনও রয়েছে রঞ্জনের দখলে। বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা গেল, বহালতবিয়তে সেই বাগানবাড়িতে পরিবার নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তৃণমূল নেতার কেয়ারটেকার। মাছ ধরা, সবজি বাগানের কাজ চলছে আগের মতোই।
সরকারি জমি দখল (Govt Land Encroachment) করায় কেন তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে মামলা করা হল না, কেনই বা তাকে গ্রেপ্তার করল না পুলিশ, আর কেনই বা এখনও সেই সম্পত্তি নিজেদের দখলে নিচ্ছে না প্রশাসন? কোনও প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। রাজগঞ্জের ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক সুখেন রায়ের কথা, ‘আমরা জমি সিল করেছিলাম। তবে এসব নিয়ে ফোনে কোনও কথা বলব না।’ জেলা প্রশাসন, পুলিশের কর্তারাও মুখ খুলতে চাইছেন না। রঞ্জনের বক্তব্য, ‘সবই মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়নের কাজে দিয়ে দিয়েছি। জমি সিল করার পর আমি আর ওদিকে যাইনি। কেয়ারটেকার ভূমিহীন মানুষ। প্রশাসন যদি ওকে বের করে দিতে চায় দেবে। আমার যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে। এসব নিয়ে আর কিছু বলার নেই।’
শুধু একা রঞ্জন নন, গজলডোবায় মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ভোরের আলো প্রকল্প ঘিরে রমরমা জমি মাফিয়াদের কারবার। কার্যত হরিলুটের বাতাসার মতো গজলডোবায় লুট হচ্ছে সরকারি জমি। একদিকে একরের পর একর খাসজমি দখল করে তৃণমূল নেতাদের কেউ তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাগানবাড়ি, কেউ বিরাট পুকুর বানিয়ে শুরু করেছেন মাছ চাষ। অন্যদিকে, দেদারে সরকারি জমি দখল করে প্লট করে বিক্রি করছেন জমি মাফিয়ারা। তাই সিল করা জমিতে রঞ্জনের দৌরাত্ম্য বন্ধ না হওয়ায় অবাক নন স্থানীয় বাসিন্দা অমল সরকার। তাঁর কথা, ‘সবই টাকার খেলা। ঠিক জায়গায় টাকা জমা হলেই সব বন্ধ হয়ে যাবে। আবার জমি বিক্রি শুরু হবে। প্রশাসনের বড়বাবুরা সব জানে। শিলিগুড়ির অনেক নেতারই জমি আছে। সাহস থাকলে সেসব জমি কেড়ে নিক সরকার।’
‘এই জমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে’ এই মর্মে রঞ্জনের বাগানবাড়িতে ঢোকার গেটেই লাগানো হয়েছে বোর্ড। কিন্তু এদিন সেই গেটে পাহারায় বসে থাকতে দেখে গেল বাগানবাড়ির কেয়ারটেকার বীরেন মণ্ডলকে। সরকারি সম্পত্তিতে তিনি কী করছেন? বীরেনের জবাব, ‘পুলিশ এসে শুধু বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে। সম্পত্তি তো রঞ্জন শীলশর্মারই। তাই ওর কেয়ারটেকার হিসাবে বাগানবাড়িতে পরিবার নিয়ে যেমন ছিলাম তেমনই আছি। রঞ্জনদা যেভাবে বলবেন সেভাবেই কাজ করব।’
মেখলিগঞ্জের নিজতরফ এলাকার বাসিন্দা বীরেন। বছর ছয়েক আগে তাঁকে গজলডোবায় নিয়ে আসেন রঞ্জন। তখন থেকেই বাগানবাড়ির দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। বীরেন জানিয়েছেন, দোতলা বাড়ির নীচতলায় পরিবার নিয়ে তিনি থাকেন। আর উপরতলায় মাঝেমধ্যে এসে থাকতেন রঞ্জন। তাঁর কথা, ‘দাদা (রঞ্জন) বাগানবাড়ির ফাঁকা অংশে রিসর্ট বানাবে বলে শুনেছিলাম। কয়েকদিন আগেই বাকি সীমানা প্রাচীরের জন্য ইট, বালি এনেছিলেন। সেই কাজটা বাকি থাকল। মনে হয় কিছুদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
সরকারি বোর্ড উপড়ে দিয়ে সেই জমি পুনরায় দখল নেওয়া মাফিয়াদের পুরোনো অভ্যাস। জমি কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ ছাইচাপা পড়লেই কি সুযোগ বুঝে ফের বাগান বাড়ির দখল নেওয়ার অপেক্ষা করছেন রঞ্জন? তাই কি কায়দা করে কেয়ারটেকারকে সামনে রেখেই কৌশলে বাগানবাড়ি নিজের কবজায় রেখে দিয়েছেন তৃণমূল কাউন্সিলার? আর রঞ্জনকে সেই সুযোগ করে দিতেই কি সব জেনেবুঝেই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন প্রশাসনের কর্তারা? এইসব নানা প্রশ্ন এখন ঘুরছে ভোরের আলোর আকাশে-বাতাসে।