আলিপুরদুয়ার

বাঙালিয়ানা আঁকড়ে গাঙ্গুটিয়া চা বাগান, ভুলেছে চুয়াপাড়া

মোস্তাক মোরশেদ হোসেন, কালচিনি : বেঞ্চের মতো করে পাতা বিদ্যুতের খুঁটিটায় বসে স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন গাঙ্গুটিয়া চা বাগানের ‘বাবু স্টাফ’ শুভ্রশংকর চট্টোপাধ্যায়। বাবা সনত্ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন লেখক। চা বাগানের কাজ সামলে চুটিয়ে লিখতেন পত্রপত্রিকায়। ‘উন্মেষ’ পত্রিকার সম্পাদনা করতেন ওই চা বাগান থেকেই। ডুয়ার্সের চা বলয়ে তখন আপাদমস্তক বাঙালিয়ানা।

গাঙ্গুটিয়ায় সাড়ে ৭ দশক আগে বাঙালিবাবুরা শুরু করেছিলেন দুর্গাপুজো। তৈরি হয়েছিল টিনের বেড়া দেওয়া দুর্গা মন্দির। আজও পুজো হয় সেখানে। তবে গোটা চা বাগানে এখন বাঙালি ‘বাবু স্টাফ’ রয়েছেন মাত্র দুজন। শুভ্রশংকর আর বিপ্লব দাস। ওঁদের সৌজন্যেই যেন আজও গাঙ্গুটিয়ার দুর্গাপুজোর পরতে পরতে বাঙালিয়ানার ছাপ। দীনেশ মাঝি, অঙ্কিত সারকি, সবুদ থাপা, সুভাষ মঙ্গর, নারায়ণ মঙ্গর, অরবিন্দ দোরজেরা দুর্গাপুজোর দিনক’টায় হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর বাঙালি। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির ওই মহল্লায় আজও শোনা যায়, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু…’।

পুরোনো সেই দিনের কথা! সবে লালমুখো সাহেবরা বিদায় নিয়েছেন। তরাই-ডুয়ার্সের চা বাগানগুলিতে বাবু স্টাফদের চেয়ারগুলিতে জায়গা নিতে শুরু করেছেন বাঙালিরা। চক্রবর্তী, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, সরকার, দাসবাবুরাই তখন হয়ে উঠছিলেন ‘দেশি সাহাব’। আদিবাসী মহল্লাতেও তখন মাথা উঁচিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি। দুর্গাপুজোর ক’টা দিন ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত উচ্চশিক্ষিত বাবুরা চুটিয়ে আড্ডা দিতেন সবুজ ভরা মাঠে। প্রসঙ্গ কবিগুরু, শরত্, বঙ্কিম আরও কত কী! এখন পুজো হয় বটে, কিন্তু বাঙালিবাবুদের আড্ডা নাম লিখিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

গাঙ্গুটিয়ার মতো কালচিনিরই চুয়াপাড়া চা বাগানেও তখন স্টাফদের বেশিরভাগই ছিলেন বাঙালি। চুয়াপাড়ায় বহুবছর কর্মরত ছিলেন গৌতম সরকার। অবসর নিয়েছেন ২০১৭ সালে। নিমতি এলাকার বাসিন্দা ছিলেন গৌতমবাবু। ওখানেই পাটকাপাড়া চা বাগান। স্মৃতির কুয়াশা হাতড়ে গৌতমবাবু বলতে থাকেন, ‘আমরা তখন একেবারেই ছোট্ট! পুজোয় আনন্দ হত এক মাস ধরে। এখনকার মতো গাড়িতে চাপিয়ে প্রতিমা আনা হত না। শিল্পীরা বাগানে এসে প্রতিমা গড়ে দিতেন। দিনের পর দিন চলত প্রতিমা গড়ার কাজ। আমরা তন্ময় হয়ে দেখতাম। এখন সবকিছুই যান্ত্রিক। সবচেয়ে বড় কথা, চুয়াপাড়ার দুর্গাপুজোয় বাঙালিয়ানা আর নেই।’

মেচপাড়া চা বাগানের মোড় থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে চুয়াপাড়া। উলটোদিকে ১১ কিলোমিটার দূরে গাঙ্গুটিয়া। মেচপাড়ার মোড়েও পুজোর মণ্ডপ বাঁধা হচ্ছে। সামনে বসানো হবে ডিজে বক্স। তবে, সেখানে ‘আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে’ শোনা যাবে না। বরং তারস্বরে বাজবে হিন্দি গান। তারই প্রস্তুতি চলছে।

সরকার অনুদান দিচ্ছে। চাঁদাও উঠছে। মণ্ডপও শক্তপোক্ত। তবে কাশফুলের মতো বাঙালি সংস্কৃতির পেলব স্পর্শটাই যেন নেই ভুটান পাহাড়ের পাদদেশের ওই চা বলয়ের দুর্গাপুজোয়।        গাঙ্গুটিয়া না হয় এখনও পর্যন্ত বাঙালিয়ানা আঁকড়ে ধরে রয়েছে। কিন্তু সেটাই বা আর ক’বছর! শুভ্রশংকরের কথায়, ‘আমি সহ আমার চার পুরুষ এই চা বাগানে কর্মরত। কিন্তু তারপর?’ তাঁর একটিমাত্র কন্যাসন্তান রয়েছে। তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম কি আসবে চা বাগানের বাবু স্টাফের চেয়ারে বসতে? কী হবে দুর্গাপুজোর? শুভ্রশংকর নিরুত্তর!

অথচ বাঙালিয়ানা না থাকলে দুর্গাপুজোই যেন অসম্পূর্ণ! নিজে অবাঙালি হয়েও এই সত্যটা উপলব্ধি করেন চুয়াপাড়ার শিব মন্দিরের পুরোহিত কেদার মহারাজ পণ্ডিত। একসময় চুয়াপাড়া চা বাগানের মালিকপক্ষ তাঁকে বিহার থেকে নিয়ে এসেছিল। কেদার মহারাজের কথায়, ‘তখন অনেক বাঙালি স্টাফ ছিল। দুর্গাপুজোয় নিয়মনিষ্ঠা ছিল। এখন সারাবছর দুর্গাপুজো হয় না। শিব মন্দিরের পাশের টিনের ঘরটায় বছরে একবার পুজো হয়। বাকি সারাটা বছর এখানে গোরু, ছাগল রাখা হয়। ভক্তি নেই।’ একরাশ হতাশা ঝরে পড়ে তাঁর গলায়, ‘এখন দুর্গাপুজোয় লোকজন আসে আনন্দ করতে। ছেলেমেয়েরা নাচানাচি করে। মেলা বসে। ডিজে বাজে। কিন্তু মুখ যেদিকে করিয়ে প্রতিমা বসানো হয় তা শাস্ত্রবিরুদ্ধ! কিন্তু কে শুনবে আমার কথা! দুর্গাপুজোর নিয়মনীতি বাঙালিরা জানে। কিন্তু গোটা বাগানে এখন বাঙালি স্টাফ রয়েছেন মাত্র ৩ জন।

চুয়াপাড়ায় আগে কেবলমাত্র বাবু স্টাফ লাইনেই দুর্গাপুজো হত। এখন পুজো হয় ৩টি জায়গায়। বাবু স্টাফ লাইন ছাড়াও শিব মন্দিরের পাশে লেবার স্টাফ লাইন এবং উপর লাইনেও পুজো হয়। লেবার লাইনের পুজোটার বয়স ৫৬ বছর। পুজোর অন্যতম কর্তা তৃণমূল নেতা সবির লোহারা। তিনি আবার পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামীও।

বাবু স্টাফ লাইনের পুজো এবার ৮৩ বছরে পা দিল। তবে জোটে না সরকারি অনুদান। ১৯৯০ সাল থেকে বাবু স্টাফ লাইনের পুজোয় জড়িয়ে ছিলেন গৌতম সরকার। তিনি খোলামেলাই বললেন, ‘পুজোর ঐতিহ্য আর নেই। কারা শুরু করেছিলেন ওই পুজো জানেন না কেউ।’

গৌতমবাবুর কথায়, ‘সিনিয়ারদের বেশিরভাগই অবসর নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। অনেকে প্রয়াত হয়েছেন। ওঁরা সব জানতেন। আসলে বাঙালি এখন চা বাগান থেকে মুখ ফেরাচ্ছে।’

পুজো শুরুর ইতিহাস জানা নেই পুজো কমিটির কর্তা অমৃত সিংয়েরও। তাঁর ভাষায়, ‘এটুকুই বলতে পারি, পুজো প্রায় ৮ দশক আগে শুরু হয়েছিল। একসময় শুধু বাবু স্টাফরাই পুজো করতেন। এখন আশপাশের এলাকার শ্রমিক ও বাবু স্টাফরা মিলেই পুজো করি।’

Sourav Roy

Sourav Roy working as a Journalist since 2013. He already worked in many leading media houses in this few years. Sourav presently working in Uttarbanga Sambad as a Journalist & Sud Editor of Digital Desk from March 2019 in Siliguri, West Bengal.

Recent Posts

IPL | ধোনির চেন্নাইকে হারিয়ে আইপিএলের চতুর্থ দল হিসাবে শেষ চারে বেঙ্গালুরু

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আইপিএলের চতুর্থ দল হিসাবে প্লে অফে উঠল বেঙ্গালুরু। বেঙ্গালুরু বনাম চেন্নাইয়ের…

3 hours ago

Siliguri | তিস্তায় জলস্তর বেড়ে আটক ২, উদ্ধারে শুরু তৎপরতা

শিলিগুড়ি: পাহাড়ে প্রবল বৃষ্টির জেরে তিস্তার জলস্তর হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় বিপত্তি ঘটলো রংপোতে। নদীতে আটকে…

3 hours ago

Patiram | ঘুমের মধ্যেই বেহুঁশ করে চুরি, যাওয়ার আগে আইসক্রিম খেলো চোরের দল

পতিরাম: এ যেন ফিল্মি কায়দায় চুরি। পরিবারকে গ্যাস স্প্রে করে অচৈতন্য করে বাড়ির সর্বস্ব চুরি…

4 hours ago

Bomb Recovered | বিস্ফোরণের পর ফের উদ্ধার জারভর্তি বোমা, নিষ্ক্রিয় করল বম্ব স্কোয়াড

কালিয়াচক: কালিয়াচকের রাজনগর মডেল গ্রামে বোমা বিস্ফোরণের পর আরও এক জার বোমা উদ্ধার (Bomb recovered)…

5 hours ago

Minority Scholarship Scam | স্কলারশিপের টাকা আত্মসাৎ! অভিযুক্ত ২ জনকে হেপাজতে চায় সিআইডি

বিশ্বজিৎ সরকার, করণদিঘি: মাইনোরিটি স্কলারশিপের (Minority Scholarship Scam) কোটি কোটি টাকা তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত মহম্মদ…

5 hours ago

Raiganj | গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ, বহালতবিয়তে ঘুরছে দুই অভিযুক্ত

রাহুল দেব, রায়গঞ্জ: আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও খুনের চেষ্টার ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার(Arrest) করেনি পুলিশ। এলাকায় বহালতবিয়তে…

5 hours ago

This website uses cookies.