বিশ্বজিৎ সরকার, রায়গঞ্জ : এই ঘটনা যেন হার মানায় সিনেমার প্লটকেও। উত্তর দিনাজপুরের জেলা শাসকের দপ্তরের এক কর্মীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কের সুবাদে সরকারি প্রকল্পের ৪ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা তছরুপ। ধরা পড়ার ভয়ে প্রথমে বালুরঘাট হয়ে দালাল মারফত বাংলাদেশে পালানোর ছক কষা। তবে ব্যর্থ হয়ে লাটাগুড়িতে আত্মগোপন। তবে শেষে দীপা সাহা অধিকারী নামে এক মহিলাকে রবিবার লাটাগুড়ি ফরেস্ট রিসর্ট থেকে গ্রেপ্তার করে রায়গঞ্জ থানার পুলিশ। ধৃতকে রবিবার দুপুরে রায়গঞ্জ মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হলে বিচারক তাঁকে ৫ দিনের পুলিশি হেপাজতের নির্দেশ দেন। ধৃতের কাছ থেকে একটি বিলাসবহুল গাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রায়গঞ্জ সিজেএম কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর নীলাদ্রি সরকার বলেন, ‘ধৃতের একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেই অ্যাকাউন্টে অবৈধভাবে সরকারি টাকা ঢুকেছে। ওই মহিলাকে গ্রেপ্তার করেছে রায়গঞ্জ থানার পুলিশ।’
রায়গঞ্জের জেলা শাসকের দপ্তরের এক ক্লার্ক কাম ক্যাশিয়ার সুব্রত চন্দের সঙ্গে দীপার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সুব্রত ও ভূমি অধিগ্রহণ বিভাগের কর্মী দেবদীপ ভট্টাচার্য দুজনে হাত মিলিয়ে মোট ৪ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা তছরুপ করে বলে অভিযোগ। উত্তর দিনাজপুর জেলার অ্যানিমিয়া কন্ট্রোল প্রকল্পের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে দীপার অ্যাকাউন্টে ওই টাকা ট্রান্সফার করা হয় বলেও অভিযোগ। টাকা তছরুপ করার জন্য তাঁরা জেলা শাসকের সই জাল করেন বলেও অভিযোগ। সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ সুব্রত সংখ্যালঘু দপ্তরের ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকার চেক কর্ণজোড়ার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ভাঙাতে গেলে ওই ব্যাংকের শাখা ম্যানেজারের সন্দেহ হওয়ায় তিনি জেলা শাসককে বিষয়টি জানান। সঙ্গে সঙ্গে সুব্রতর কারচুপি ধরা পড়ে যায়। ১৪ সেপ্টেম্বর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দোরজি শেরপা রায়গঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তারপরই পুলিশ তদন্তে নেমে ১৫ সেপ্টেম্বর সুব্রত ও দেবদীপকে গ্রেপ্তার করে। ক্যাশিয়ার হওয়ার সুবাদে সুব্রতর চেক ডিসপ্যাচ করার ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে সুব্রত সরকারি প্রকল্পের টাকা দীপা এবং আরও দুজনের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করতেন বলে অভিযোগ। অভিযোগ দায়ের পরই দীপা গা-ঢাকা দেন।
তদন্তে জানা গিয়েছে, প্রথমে বালুরঘাটের একটি হোটেলে লুকিয়ে ছিলেন দীপা। ৫ অক্টোবর পর্যন্ত হিলির দালাল মারফত বাংলাদেশে পালানোর ছকও কষেছিলেন। তবে ব্যর্থ হন। ৭ অক্টোবর নিজের গাড়িতে করে ব্যক্তিগত চালক সহ জলপাইগুড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। শেষমেশ রবিবার লাটাগুড়ির রিসর্ট থেকে পুলিশ দীপাকে গ্রেপ্তার করে। দীপার নামে মোট ১৬টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। তাঁর নামে ফ্ল্যাট সহ একাধিক জমির হদিসও পাওয়া গিয়েছে। এসবই সরকারি প্রকল্পের টাকায় কেনা হয়েছে। রায়গঞ্জ পুলিশ জেলার সুপার মহম্মদ সানা আক্তার বলেন, ‘এই ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশি হেপাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
এদিকে, জেলা শাসকের দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, সুব্রত এর আগেও পাঁচ লরি বন্যার ত্রাণের ত্রিপল বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তা নিয়েও তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। দীপা ছাড়াও সুব্রতর আরও ১২ জন প্রেমিকার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। সবাইকেই সুব্রত সরকারি প্রকল্পের টাকায় অনেক উপহার দিয়েছেন বলে অভিযোগ। দীপার সঙ্গে আরও এক শিক্ষকের সম্পর্কের কথা পুলিশ জানতে পেরেছে। যদিও তদন্তের স্বার্থে পুলিশ এখন সেই শিক্ষকের নাম প্রকাশ্যে আনছে না। এই ঘটনার পিছনে অন্য কোনও বড় মাথার হাত আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

