Monday, July 1, 2024
Homeকলামলোভ টেনে ধরার চেষ্টায় লাগামটা না ছিঁড়ে যায়

লোভ টেনে ধরার চেষ্টায় লাগামটা না ছিঁড়ে যায়

গৌতম সরকার

তুমি কে হে ভাই, ট্যাক্স বাড়ানোর! এমন মুখঝামটা বোধহয় বাকি জীবন মনে রাখবেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। তৃণমূলের প্রতিষ্ঠালগ্নের নেতা। এখন কোচবিহার পুরসভার চেয়ারম্যান। ব্যবসায়ীদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে কর বাড়িয়েছেন। ভোটের আগে প্রকাশ্য সভায় খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচন মিটতেই ফের কর বৃদ্ধির ঘোষণা করে ‘দিদি’র রোষে পড়লেন একেবারে ক্যামেরার সামনে বৈঠকে।

ঢোঁক গিলতে হল কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীকেও। তিনি ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান। জঞ্জাল কর চালু করবেন ঘোষণা করেছিলেন। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনও পুরসভা কোনও কর আদায় করতে পারবে না। ফলে উভয়সংকটে কৃষ্ণেন্দু। জঞ্জাল কর আদায় না করলে সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট খাতে বরাদ্দ করবে না বলে কেন্দ্র শাসিয়েছে।

করের বোঝা না চাপিয়ে নাগরিক পরিষেবা নিশ্চিত করা তৃণমূল নেত্রীর ঘোষিত সংস্কৃতি। কলকাতার মেয়র থাকাকালীন প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে পর্যন্ত জলকর বসিয়ে তুলে নিতে হয়েছিল মমতা রুষ্ট হওয়ায়। পার্কিং ফি বাড়িয়ে তুলে নিতে হয়েছে এখনকার মেয়র ফিরহাদ হাকিমকেও। মানুষকে নিঃশুল্ক পরিষেবা দেওয়ার চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না নিঃসন্দেহে। পরিষেবা দিতে সরকার, পুরসভা দায়বদ্ধও বটে।

কিন্তু প্রশ্নটা অন্য। জনগণের পকেট না কেটে পরিষেবা দিতে ট্যাঁকের জোর চাই। তা কি সরকারের আছে? চুরিচামারি, দুর্নীতিতে প্রশাসন, পুরসভার অর্থ অপচয় যেমন ঘোর বাস্তব, অর্থকষ্ট তেমনই পুরসভা, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষগুলির নিত্যসঙ্গী। সরকারি দপ্তরও টাকার অভাবে অনেক সময় প্রকল্প রূপায়ণে পঙ্গু হয়ে থাকে। সরকার টাকা জোগাতে না পারলে পরিষেবা, উন্নয়ন হবে কোথা থেকে!

বিকল্প ভাবনা নিয়ে কোনও স্তরে কোনও আলোচনা কখনও শুনিনি। সরকারি নির্দেশিকা আছে বলেও জানি না। অথচ নিঃশুল্ক পরিষেবা নিশ্চিত করতে অর্থের উৎস ঠিক করে দিতে হবে পুরসভাকে। পুরসভার যে কয়েকটি উৎস আছে, তা দিয়ে বিপুল কর্মযজ্ঞ সত্যিই কঠিন। কিন্তু সরকারের জনহিতকর ভাবমূর্তি তুলে ধরতে কর বসানোয় ঘোর আপত্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ভোটের স্বার্থে এই কৌশল।

কিন্তু এতে অনৈতিক ধান্দার পথ তৈরি হয়। সরকারে আসার কয়েক বছরের মধ্যে তৃণমূলের এক জেলা সভাপতি সেই ধান্দার বাধ্যবাধকতা শুনিয়েছিলেন, ‘আমাদের রসিদ ছাপিয়ে চাঁদা তোলা বারণ। ব্যবসায়ীদের কাছে দলীয় কর্মসূচির জন্য টাকা চাওয়া নিষেধ। অথচ জেলায় জেলায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকের পর জনসভায় লোক আনার দায়িত্ব আমাদের ঘাড়ে।’ বছর আটেক আগে তিনি হিসেব কষে বুঝিয়েছিলেন, মোটামুটি সভা ভরানোর মতো লোক আনতে কম করে ৪০ লক্ষ টাকা দরকার।

সেই জেলা সভাপতির প্রশ্ন ছিল, ‘মুখ্যমন্ত্রী বছরে দু’বার জেলায় সভা করলে কত খরচ বলুন? এই টাকা পাব কোথায় আমরা?’ তিনি বুঝিয়েছিলেন, বাধ্য হয়ে নানা ধান্দায় সেই টাকা জোগাড় করতে হয়। সেই ধান্দায় যে নানা অনৈতিক বিষয় থাকে, বিভিন্ন শর্ত থাকে, তা মেনে নিয়েছিলেন তৃণমূলের সেই প্রবীণ নেতা। এখন হঠাৎ মমতা খড়্গহস্ত হয়ে ওঠায় এই নেতারা বিপাকে। সরকারি জমি জবরদখল, যত্রতত্র হকার বসানো, ফুটপাথকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কাউন্সিলারদের তো বটেই, প্রয়োজনে পুলিশকর্মী বা কর্তাকে গ্রেপ্তার করার হুমকি দিয়েছেন।

অন্যায়গুলি নতুন নয়। মালদায় এখন পুকুর ভরাট বন্ধ হল। দিনের পর দিন যখন ওই অপরাধ হচ্ছিল, তখন না পুলিশ, না প্রশাসন, না পুরসভা বাধা দেওয়া দূরে থাক, আপত্তিও জানায়নি। কোচবিহার ও দিনহাটায় ফুটপাথ, রাস্তা দখল করে ব্যবসায় যুক্তদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ আদায় করে পুরসভা। সেই টাকা পুরসভার কোন খাতে কীভাবে জমা পড়ে, সেটাই রহস্য।

শিলিগুড়িতে শাসকদলের কিছু নেতার মদতে সেবক রোডের মতো ব্যস্ত রাস্তার দু’ধারে হকার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিছু দুষ্কৃতী তোলা আদায় করে নিয়মিত। শিলিগুড়ি মহকুমায় জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য, ভূমি দপ্তরের একাংশের যোগসাজশ মুখ্যমন্ত্রীর অজানা নয়। এজন্য তিনি বহুবার শিলিগুড়ি পুলিশকে সতর্ক করেছেন। তদন্তও হয়েছে। কিন্তু অন্যায়গুলি বন্ধ হয়নি। এতদিনে মমতা নবান্নের বৈঠকে সবার সামনে গৌতম দেবকে সতর্ক করলেন, ‘তুমি এর দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারো না।’

হকারদের পাশাপাশি অনেক গরিব মানুষ দুষ্কৃতী, মাফিয়া বা তোলাবাজদের এই অন্যায়ে নিজেদের জড়িয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। এখন উচ্ছেদ হলে তাঁরা নিশ্চিতভাবে রুজিরুটি হারাবেন। শহরের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীদের কাছে ভালো সাজতে গিয়ে কোপ পড়ছে গরিবের ওপর। ভালো সাজতে গিয়ে খারাপের আশঙ্কায় শেষপর্যন্ত মমতা নিজেই তাই এই অভিযানে রাশ ধরেছেন। বন্ধ হয়ে গিয়েছে উচ্ছেদ। সরকারি জমি পুনরুদ্ধারও সম্ভবত থমকে।

বেসরকারি জমিতে সিন্ডিকেটরাজ বন্ধ হবে, এমন নিশ্চয়তাও নেই। শিলিগুড়ি লাগোয়া জলপাইগুড়ি জেলার ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির তৃণমূল নেতা দেবাশিস প্রামাণিককে গ্রেপ্তার করলেও অন্য রাঘববোয়ালদের ধরার সবুজ সংকেত পায়নি পুলিশ। তার ওপর যাঁরা একবার কালা ধান্দায় মোটা টাকা কামানোর স্বাদ পেয়েছেন, তাঁদের সেই পথ থেকে ফেরা কঠিন।

২০২৬-এর বিধানসভা ভোটের লক্ষ্যে নিজের দল ও প্রশাসনের ওপর মমতা হম্বিতম্বি করছেন। কিন্তু তার দীর্ঘস্থায়ী সুফলের আশা কম। ঝুড়িতে একটি আলু পচে গেলে ফেলে দিতে হয়। কিন্তু ঝুড়ির সব আলু পচে গেলে করার কিছু থাকে না। পরিস্থিতিটা এখন সেরকম। অনৈতিক পথে চলতে দিয়ে হঠাৎ টেনে ধরলে লাগামটাই ছিঁড়ে যেতে পারে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Woman Thrashed | স্বামীর মৃত্যুতে ডাইনি অপবাদে গৃহবধূকে মারধর! কাঠগড়ায় শ্বশুরবাড়ি

0
ফাঁসিদেওয়া: চোপড়ার লক্ষ্মীপুর কাণ্ডের ছায়া এবার ফাঁসিদেওয়াতে (Phansidewa)। সংশ্লিষ্ট ব্লকের চটহাট পেটকিতে ডাইনি অপবাদে এক গৃহবধূকে বেধড়ক মারধরের (Woman Thrashed) অভিযোগ উঠল শ্বশুরবাড়ির লোকেদের...

EURO CUP | জর্জিয়াকে ৪-১ গোলে হারিয়ে ইউরো কাপের শেষ আটে স্পেন, কোয়ার্টারে প্রতিপক্ষ...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ইউরো কাপের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে জর্জিয়াকে ৪-১ গোলে হারিয়ে শেষ আটে পৌঁছে গেল স্পেন। ইউরো কাপ যত এগোচ্ছে, তত বিধ্বংসী হয়ে...

Delhi | ভারী বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত রাজধানী, লাল সতর্কতা জারি মৌসম ভবনের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: লাগাতার ভারী বৃষ্টিতে ব্যাহত সাধারণ জনজীবন। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই রাজধানী সহ সংলগ্ন এলাকায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি(Heavy Rain)...

J P Nadda | ‘দিদির পশ্চিমবঙ্গ মহিলাদের জন্য নিরাপদ নয়’, চোপড়ার ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ সালিশি সভার নামে তালিবানি অত্যাচারের ঘটনা ঘটল উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায়! বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে যুবক যুবতীকে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ উঠল এক...

Bone Cancer | হাড়ের ক্যানসার হলে কী কী লক্ষণ দেখে চিনবেন?

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: হাড়ে দীর্ঘ দিন ধরে যন্ত্রণা হতে থাকলে তা বাতের ব্যথা বলে এড়িয়ে যান অনেকে। বেশিরভাগ মানুষই বুঝতে পারেন না, হাড়ের...

Most Popular