স্বপনকুমার চক্রবর্তী, হবিবপুর: সড়কপথে দূরত্ব মোটামুটিভাবে ১২০০–১৩০০ কিলোমিটার। ‘লইবাড়ি হাট’–এর কল্যাণে মালদা হবিবপুর আর মণিপুরের ইম্ফলের সেই দূরত্ব যেন হেলায় উধাও। হবিবপুরের একটি গ্রাম লইবাড়ি। ‘লইবাড়ি হাট’ এখানেই বসে। বিশেষত্ব বলতে এটি পুরোপুরিভাবে মহিলা পরিচালিত। বিক্রেতারা তো বটেই, এই হাটে যাঁরা কেনাকাটা করতে আসেন তাঁরাও বেশিরভাগই মহিলা। অনেকেই জানেন, ইম্ফলেও এমনই একটি হাট বসে। ‘ইমা কিথল’ নামে সেই হাট ‘মায়েদের হাট’ নামেও পরিচিত। পার্থক্য বলতে, ইম্ফলের সেই হাট দেশজুড়ে সবার কাছে যতটা পরিচিত, হবিবপুরের হাটটি মোটেও ততটা নয়। অথচ এই হাটের ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরোনো। কম করেও অন্তত ৫০ বছর। এই সময়কালে এটি ধীরে ধীরে বেড়ে কলেবরে আজ অনেকটাই বড়। মালদা জেলায় তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গে এমন হাট দ্বিতীয়টি নেই। মণিপুরের হাটটিকে বাদ দিলে দেশে হয়তো এমন আর কোনও তৃতীয় হাটের খোঁজ নেই।
কী নেই এই হাটে? টাটকা শাকসবজি, দেশি মাছ, মাংস, ডিম। বিক্রেতাদের অনেককে দেখা গেল বাড়ির পোষ্য হাঁস, মুরগি নিয়ে এসেছেন। স্টিলের পাত্রে বাড়ির পোষা গোরুর দুধ নিয়েও অনেককে সেখানে দেখা গেল। অর্থনীতিতে ‘ইউএসপি’ বলে একটা শব্দ আছে। ইউনিক সেলিং পয়েন্ট। অর্থাৎ যে বিশেষ গুণের জন্য কোনও সামগ্রী বাজারে খুব ভালোভাবে বিকোয়। রোজকে রোজ সংসারের লড়াই সামলে এই বাজারে যাঁরা বিক্রিবাটা সারেন তাঁদের কাছে ‘ইউএসপি’ শব্দটি অনেকটাই দূরের। অর্থ জানেন কি না বলে প্রশ্ন করা হলে পুষ্প মণ্ডল নামে এক বিক্রেতা স্বাভাবিকভাবেই ঘাড় নাড়লেন। বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর অবশ্য তাঁর মুখে হাসি ঝলমল, ‘হাটে যা কিছু বিক্রি হয় সবই কিন্তু আমাদের ঘরের। বাইরের নয়।’ হাট ঘুরে সব দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল ‘লইবাড়ি হাট’–এর ইউএসপি নিয়ে একটি বিজ্ঞাপনী ক্যাচলাইন লিখলে অনায়াসে লেখা যায় ‘বিশুদ্ধ ও খাঁটি’।
এমন একটি ক্যাচলাইন করা গেলে তা যে মোটেও ভুল হবে না সেটা হাটে বাজার করতে আসা ক্রেতা নমিতা রায় মেনে নিলেন। বললেন, ‘এখানে এসে কেনাকাটা সেরে কোনওদিন খারাপ কিছু পাইনি। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর এসব খারাপ বলে কেউ কোনওদিন অভিযোগ করেনি।’ নমিতার মতো অভিজ্ঞতা প্রায় সবারই। তাই তাজপুর, শোলাডাঙ্গা, কালপেঁচি, ডাঙ্গাপাড়া, মেস্তরপাড়া, বেলতলা সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেরই এখানে নিয়মিত আনাগোনা।
তবুও তুলনা এসেই পড়ে। স্বামীদের কেউ কৃষিকাজ করেন, কেউবা দিনমুজর। সংসারে একটু সুখের আশায় হেমলতা মণ্ডলরা এই হাটে এসে পসার সাজিয়ে বসেন। মণিপুরের ইমা কিথল হাটের নাম শুনেছেন? নামটা শুনে হেমলতা হেসেই কুটিপাটি। তারপর সব শুনে তাঁর সহজসরল প্রশ্ন, ‘ওরাও কি আমাদের দেখে এমন হাট শুরু করেছে?’ পরে ওই হাটের বিষয়ে আরও কিছু শুনে বিড়বিড় করে বললেন, ‘কী আজব এই দুনিয়া!’
দুনিয়া সত্যিই আজব। নইলে দিনকেদিন যেখানে সবকিছুর দাম মারাত্মকভাবে বেড়ে চলে সেখানে প্রতি সপ্তাহের রবি ও বৃহস্পতিবার বিকেলে বসা লইবাড়ি হাটের সমস্ত সামগ্রীর দাম সাধারণের অনেকটাই নাগালে। আর সেই সুবাদে ভালো বিকিকিনির সুবাদে বিক্রেতার মুখে হাসি, ক্রেতারাও। সরকারি সহযোগিতা পেলে এই হাসি আরও চওড়া হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে কল্পনা মণ্ডলের মতো বিক্রেতারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সরকারিভাবে হাটখোলার জন্য টিনের ছাউনি সহ উঁচু বাঁধানো মেঝে, বর্ষায় হাটের জল যাতে সহজে বের হতে পারে সেজন্য ব্যবস্থার দাবিও জোরালো হয়েছে।