মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫

হিমন্তই রোল মডেল শুভেন্দু, শংকরদের

শেষ আপডেট:

রূপায়ণ ভট্টাচার্য

গাড়িটা তখন বিধানসভার কাছেই। অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে কলকাতার রাজপথে ট্যাক্সিচালক যে কথাটা বললেন, তা মাথায় গেঁথে থাকার মতো। ‘এই নেতারাই দেখবেন আমাদের বাংলায় দাঙ্গা লাগিয়ে দেবে ভোটের মুখে।’

তিনি বিহারের লোক। অথচ বাংলাকেই তাঁর পছন্দ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য। বাংলার কিছু নেতার কাছে যে শব্দটি কার্যত অর্থহীন আজ।

‘এই নেতারা’ বলতে ট্যাক্সিচালক সেদিন শুভেন্দু অধিকারী, শংকর ঘোষ এবং হুমায়ুন কবীর, সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীদের কথাই বলছিলেন। যে বিধায়কদের সাম্প্রতিক মন্তব্য শুনে মনে হবে, এঁরা কি কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় বঙ্গবিভূষণ হতে চান? আমজনতার কেউ এসব কথা বললে তাঁদের জেলে পাঠানোর দাবি উঠত না?

এই জাতীয় মন্তব্যগুলোকে দশ বছর আগেও উসকানিমূলক ধরা হত। এখন তো সামাজিক মাধ্যমে এমন হলাহলেরই ফুলঝুরি। যাঁরা লিখছেন, তাঁরাই সুপার হিরো।

সামনে ইদ, রমজান চলছে, জুম্মাবারেই দোল, উত্তরপ্রদেশে সম্ভল শহরে দোলের দিন সমস্ত মসজিদ ত্রিপলে ঢেকে দিতে হচ্ছে–এসব দেখেশুনেও হুঁশ নেই বাংলার এই উগ্রবাদীদের। ভিনরাজ্যের ট্যাক্সিচালক যা বুঝতে পারছেন, এই বঙ্গজ নেতারা সেটা জানেন না। তাঁরা বোঝেন শুধু ভোট–হিন্দু ভোট, মুসলিম ভোট। এবং এখন এমন ণত্বষত্বজ্ঞানহীন লোকেরাই রাজনীতি ও সামাজিক মাধ্যমে দলের সম্পদ। দুটো বড় পার্টির শিক্ষিত নেতারা সব দেখেও নীরবতার চাদর গায়ে বসে।

বঙ্গ বিজেপির যে মুখগুলো আসলে দল পালটে গেরুয়াধারী, অতীতে আরএসএসের মধ্যে কেউটে সাপ দেখতেন, তাঁদের অধুনা আদর্শ অসমের মুখ্যমন্ত্রী দলবদলিয়া হিমন্ত বিশ্বশর্মা। আগে বলা হত, আরএসএসের আশীর্বাদ মাথায় না থাকলে কোনও রাজ্যে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যায় না। বিশ্বশর্মা প্রাণপণ চেষ্টায় ছিলেন নিজেকে ঘোরতর মুসলিমবিদ্বেষী প্রমাণ করার। এবং তাতে ফল পেয়েছেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালকে কেন্দ্রে কার্যত ‘দেশান্তরী’ করে অসম মুঠোয় নিয়েছেন হিমন্ত। যা খুশি বলছেন মুসলিমদের নিয়ে। সেই পথেই বাংলার নব্য বিজেপিরা।

শুভেন্দু পদ্মপ্রেমে ডুবেছেন তৃণমূল ছেড়ে। চে গেভারার উল্কি হাতে আঁকা শংকর গিয়েছেন সিপিএম থেকে বিজেপিতে। তাঁরা যে এখন কত হিন্দুত্ববাদী, দলে তাঁদের প্রমাণ করার দায় অনেক। তাই লাল টিপ, আর মুসলিম বিদ্বেষে দুই ‘শ’ পাল্লা দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন কথাবার্তায়। তাঁদের তুলনায় দিলীপ ঘোষ, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত ম্লান। তমলুক আর শিলিগুড়ির বহু লোক ভাবেন, আচ্ছা, এঁদের সঙ্গে আমরা এককালে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে একসঙ্গে হেঁটেছিলাম না? যন্ত্রণায় দগ্ধ দ্বিধার জন্ম দেন, ওই দৃশ্যগুলো কি সব স্বপ্ন ছিল?

ঘরের পাশে সোনার বাংলা জাতিগত দ্বন্দ্বে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। হত্যা, হত্যা, লুট, লুট… প্রাণভয়ে বহু বাংলাদেশি দেশছাড়া। চলছে জঙ্গলরাজ। শুভেন্দু-শংকররা কি এসব দেখেও দেখতে পাচ্ছেন না? হুমায়ুন-সিদ্দিকুল্লাহ? তাঁরাও তো উসকানিমূলক কথাবার্তায় ওস্তাদ।

এই ২০২৫-এ যে কোনও ভদ্রলোক হিন্দু-মুসলিম তুলে কথা বলতে পারেন, বিশ্বাস হয় না। তবে এটাই বাস্তব। শুভেন্দু উবাচ, ‘ওদের দলের যে ক’টা মুসলমান বিধায়ক জিতে আসবে, চ্যাংদোলা করে তুলে রাস্তায় ফেলব। এই রাস্তায় ফেলব।’ হুমায়ুনের পালটা হুংকার, ‘এই কথা প্রত্যাহার না করলে ৪২ জন বিধায়ক বিধানসভার ভিতরে আপনার যে ঘর আছে, তার বাইরে আপনাকে আমরা বুঝে নেব। আপনি পারলে ৬৬ জন নিয়ে আমার মোকাবিলা করবেন।’ ইনি বলছেন, রাস্তায় তুলে ফেলার কথা। উনি বলছেন, ঠুসে দেওয়ার কথা। চমৎকার! পাড়ার মস্তানরাও এভাবে কথা বলে না আজকাল।

বিধায়কদের মুখে মস্তানদের বুলি শুনে একদল আনন্দ পেতে পারে, তবে সমাজের ক্ষতিই। গ্রামে, মফসসলে আধা-সিকি নেতাদের আরও দাদাগিরি বাড়বে এসব দেখেশুনে। প্রভাব পড়বে সাধারণের ওপর।

এই তো পঞ্জাবের মোহালিতে সামান্য পার্কিং নিয়ে তর্কাতর্কিতে প্রাণ চলে গেল এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর। কলকাতার বিজয়গড়ও এমন দৃশ্য দেখেছে সপ্তাহ আগে। শিক্ষিতরাও এত উগ্র হচ্ছেন কেন?

বাজে কথা বলার জন্য রাজ্যের কিছু নেতা অবশ্য মুখিয়ে থাকেন এখন। সৌগত রায়ের বড় সাধ হয় রোহিত শর্মাকে নিয়ে ক্রিকেটীয় জ্ঞান বিলোনোর। নবদ্বীপের তৃণমূল পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহার নাম কেউ শুনেছেন? শোনেননি। তাঁরও তো সাধ হয় খবরে থাকতে। তাই অনায়াসে বলে দেন, দোলের সময় তিনদিন নবদ্বীপে সবারই নিরামিষ খাওয়া উচিত।

একবার বলেন, এটা অনুরোধ। একবার বলে দেন, ওটা আইন। বাংলার বিভিন্ন শহরেই এমন অনেক লোককে পাবেন। উত্তরবঙ্গে যেমন উদয়ন গুহ, সুকান্ত মজুমদার, নগেন রায়, রহিম বক্সী…। আচ্ছা, বাই দ্য ওয়ে, নিশীথ প্রামাণিক কোথায় হারিয়ে গেলেন?

আসলে তৃণমূলের অধিকাংশ নেতা বিজেপির পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন। অনেকটা বিভ্রান্তও। বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের স্টেনগানের মোকাবিলা কী পথে করবেন। তাঁরাও কি প্রমাণ করতে যাবেন, আমরাও হিন্দু, হাম কিসিসে কম নেহি?

এসব দেখেশুনে আবার সেই হিমন্ত–শুভেন্দুর নিজেদের আপ্রাণ প্রমাণের অঙ্ক ও কপালের সিঁদুরের টিপ মনে পড়ে যায়।

Categories
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

গুমরে মরছে দিনাজপুর ও মালদা

অভিজিৎ সরকার উত্তরবঙ্গের নাম উচ্চারিত হওয়ামাত্রই পর্যটন প্রসঙ্গটি অনিবার্যভাবে আমাদের...

আস্তিনের শেষ তাসে ঝুঁকির খেলা শুভেন্দুদের

গৌতম সরকার মাঝে মাঝে শুভেন্দু অধিকারী রসিকতার ছলে হুংকার দেন-...

ভুল নামের মণিমুক্তোয় শিলিগুড়ির ধোঁয়া-ধোঁয়া

রূপায়ণ ভট্টাচার্য এনজেপি স্টেশনের ফাঁকা পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এক নামগোত্রহীন...

এভাবেও ফিরে আসা যায়…

  পার্থসারথি চক্রবর্তী সুনীতা উইলিয়ামসদের ঘরে ফেরা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের জয়।...