হিমাংশু রায়
ফিজিক্সের ছেলেপুলেরাও গল্পের বই পড়ে!
প্রথম যখন দেখা হল, এমন অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া ছিল সুমনদার। রিসার্চ ল্যাবের সঙ্গী সুজনদা মেকানিক্স, স্ট্যাটিস্টিক্সের চাইতে রুমি, কাহলিল গির্বান, ড্যানিয়েল ল্যাডিনস্কির লেখা পড়তে বেশি আগ্রহী। সেদিন বলছিলেন, ‘আমি ইংরেজি নিয়ে পড়লে বেশি ভালো করতাম বোধহয় বুঝলি।’
কথা হল, পাঠক্রমের বই বাদে আমরা অন্য বই পড়ব কেন? গল্প, কবিতা বা যে কোনও সাহিত্য নিয়ে চর্চা করে লাভ কী?
আসলে শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা মানুষকে সম্পূর্ণ করে তোলে না। দরকার সমাজ সম্পর্কে সামগ্রিক জ্ঞান। ইতিহাসের অনেক ঘটনা বা একটি নির্দিষ্ট সময়কে নিয়ে গল্প, উপন্যাস লেখা হয়। সেখানে ঘটনাগুলোর পটভূমি, সামাজিক আর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব সম্পর্কে জানা যায়।
আমরা জানি, ব্রিটিশরা ভারতে কবে এসেছিল, কতদিন শাসন করেছিল, কীভাবে নির্যাতন চালিয়েছিল ইত্যাদি। কিন্তু কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ইংরেজের মুক্তচিন্তার সৌজন্যে যে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সদর্থক বদল এসেছিল, তা জানতে পারি গল্প-উপন্যাস পড়ে। জানতে পারি তাঁতিয়া টোপি, রানি লক্ষ্মীবাইয়ের সাহসের বর্ণনা।
বই পড়ে নিজের মাটিকে চিনতে পারবে তুমি। উত্তরবঙ্গের ইতিহাস, জনজাতি ও তাঁদের সংস্কৃতি, চা বাগানের মহল্লা, পাহাড়ের ঢালে লুকিয়ে থাকা হাজারো অজানা গল্প জানতে পারবে। বিমলেন্দু মজুমদারের লেখা ‘প্রান্তীয় উত্তরবঙ্গের লোক ইতিহাস’, ‘বিরহড় : একটি বনচারী আদিম আদিবাসী’, ‘টোটো ফোক টেলস’। কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্যের কলমে ‘পশ্চিমবঙ্গের জনজাতি’। চারুচন্দ্র সান্যাল রচিত ‘দ্য রাজবংশীস অফ নর্থ বেঙ্গল’, ‘ দ্য মেচেস অ্যান্ড টোটোস অফ নর্থ বেঙ্গল’ উল্লেখযোগ্য পাঠ্য।
এসবের পাশাপাশি ‘নীলকণ্ঠ পাখির দেশে’ পড়লে দেশভাগের সময়কালের অবস্থা জানা যায়। ‘কালবেলা’ ও ‘হাজার চুরাশির মা’তে ফুটে ওঠে নকশাল আন্দোলনের পটভূমিকা। ‘একাত্তরের দিনগুলো’ পড়লে মুক্তিযুদ্ধের কথা জানা যাবে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস যেন ঘটনার জীবন্ত দলিল।
তবে একটা কথা ঠিক, একটি উপন্যাস পড়ে পুরো ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় না। সেজন্য গবেষণার ওপর ভিত্তি করে লেখা বই পড়া যেতে পারে। উপন্যাস আসলে একটা নির্দিষ্ট সময়কে ভিত্তি করে লেখা গল্প। সে সময়ের পরিস্থিতি বা কোনও বাস্তব চরিত্র সম্পর্কে শক্তপোক্ত ধারণা পাবে। যদিও সবকিছুতে লেখকরা স্বাধীনতা নিয়েছেন নিজের মতো করে।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতে, ‘কল্পনাশক্তি জ্ঞানের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ সেই কল্পনাশক্তিকে সমৃদ্ধ করে গল্প, কবিতার বই। সিনেমা যে দৃশ্য পর্দায় আলো ফেলে দেখায়, সেই দৃশ্য বইয়ের পাতা থেকে কল্পনায় টেনে আনার মধ্যে এক অন্যরকম উত্তেজনা আছে, তা বিভূতিভূষণের আরণ্যক পড়ে বোঝা যায়। এর জন্য বই পড়তে হবে। প্রচুর পড়তে হবে। লেখাপড়াকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার পর, মাতৃভাষার চর্চা ভীষণ জরুরি। এটা গর্বেরও। মাতৃভাষায় লেখা সাহিত্য আমাদের দ্রুত সংযুক্ত করে।
কল্পনাশক্তি সৃষ্টিশীল মানুষ হতে সাহায্য করে। সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে অনুভূতি, সহানুভূতি একটু বেশি থাকে। কারণ যারা সৃষ্টির আনন্দ খুঁজে পেয়েছে, তারা আর ধ্বংসের দিকে হাত বাড়াবে কেন? মানুষ সুযোগ পেলেই সুখ খোঁজে। বই যন্ত্রণা ভোলাতে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। বই কিন্তু একজন ভালো বন্ধুও। একাকিত্ব গ্রাস করলে সে হাত বাড়িয়ে টেনে তোলে। আনন্দ দেয়, হাসায়, আবার কাঁদায়ও। মনকে ছুঁয়ে যায়।
সব মানুষ এক নয়। উপন্যাস, গল্পের চরিত্রে বৈচিত্র্য সহ বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষ ও মানুষের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব, পরিস্থিতি ও সেই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর উপায় সম্পর্কে ধারণা দেয়।
বিজ্ঞান সম্পর্কিত বই, পত্রিকা বা ম্যাগাজিন জ্ঞানের আলো জ্বালে। খবরের কাগজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংবাদপত্র আসলে একটি দিনের লিখিত দলিল। ইতিহাস দেশ ও বিশ্বের সঙ্গে পরিচিতি ঘটায়। সাহিত্য আর নীতিকথা অনুভব, অনুভূতি, রাগ, ভালোবাসা, হাসির মতো উপাদান জুড়ে জুড়ে মানবিকতার বৃত্ত তৈরি করে। সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হোক সকলের মধ্যে।
(লেখক উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, মাথাভাঙ্গার বাসিন্দা)