- মৈনাক ভট্টাচার্য
বছর শেষ হলে, সালতামামি নিয়ে বসা আমাদের অভ্যেস। এটা এক অর্থে বছরের অনুরণন, তাই অচিরে থেমেও যায়। ইতালীয় শিল্পী মাউরিজিয়ো ক্যাতেলনের কনসেপচুয়াল আর্ট ‘কমেডিয়ান’-এর কলার গল্পটাকে কিন্তু কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না।
গত নভেম্বরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর্ট বাসেলের প্রদর্শনী হলের দেওয়ালে ক্যাতেলন নালি টেপ দিয়ে সেঁটে দিলেন ত্রিশ সেন্ট, আমাদের এক টাকার আশপাশ দরে কেনা সাধারণ মানের একটা কলা, ব্যাস- কেল্লা ফতে। ছয় দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ সাড়ে বাহান্ন কোটি টাকায় বিক্রি করে ফেললেন। শিল্পের ইতিহাসে এই ধারণা নতুন কিছু নয়, বিংশ শতকের শুরুর ডাডাইজমেরই প্রতিরূপ মাত্র। ধারণাগত শিল্পীরা মূলত ঐতিহ্যগত শৈল্পিক ধারণাকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করতেই পরিচিত। তবু কলা কেনার কারণ বিশ্লেষণে প্রতিদিনই নিত্যনতুন গল্প বাজারে আসছে। মূল গল্প কিন্তু শিল্পী ক্যাতেলনের বাজার তৈরির মজ্জাগত ক্যারিশমা, সেটা তাঁর ইতিহাস ঘাটলেই বোঝা যায়।
‘কমেডিয়ান’কে ক্যাতেলন অবশ্য প্রতিস্থাপন করলেন বিশ্ব বাণিজ্যের ইঙ্গিতবাহী উদ্যোগের পাশাপাশি হাস্যরসের এক ধ্রুপদি প্রতীক হিসেবে। শিল্প ভাস্কর্যের দরটাই যে এই সত্য ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে। পালটায় তার আখ্যানভঙ্গি, তার কথনবয়ন। এভাবে বাজার তৈরির কথা আমাদের কেউ ভাবতেই শেখায় না যে, আসল সত্য হল ওই শিল্পমিথস্ক্রিয়ার মেটামরফোসিস। যা মূলত দুটি বস্তু বা ব্যক্তির পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া বিনিময়ের মাধ্যম এটিকে শিল্পে পরিণত করতে পারে।
এখানকার শিল্পীদের ছবির রং রশদে এবং ভাস্কর্যে প্রকৃতির আবহ এক আলাদা পরিমণ্ডলের ব্যাপ্তি বহু চর্তিত। আমাদের তাই কনসেপচুয়াল আর্টের কাছে না গেলেও চলে। শুধু দরকার শিল্পকে বাজারজাতকরণের নেতৃত্ব। উত্তরবঙ্গের কত কিছু আছে ভাবুন তো। তিস্তা রঙ্গিতের প্রেমের গল্প এখনও আদি অকৃত্রিম। এখানে মৌন জ্যোৎস্নার মাঝরাতে, ফিনের তাঁতি, পাইড হর্নবিলের মতো অনেক পাখিকে সাক্ষী রেখে পুেরানো পাহাড় প্রায়শই গলে নতুন করে জন্ম নেয়। উত্তরের ক্যানভাসে তাই রঙের প্রাঞ্জলতার কাছে হার মানে কৃত্রিম রঙের টোন। এমন পরিমণ্ডলই তো শিল্পী তৈরির জন্য আদর্শ। ঘরে ঘরে শিশু-কিশোরের দলের ছবির চর্চার প্রবণতা। শনি, রবিবারের আঁকার স্কুলগুলির উপচে পড়া ভিড় দেখলেই টের পাওয়া যায়। ওয়ার্ড উৎসবগুলি এই পড়ে পাওয়া বাজার ধরতে বসে আঁকো প্রতিযোগিতাকে প্রাধান্য দেয় কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু শিল্পীরা জানেন প্রতিনিয়ত ক্যানভাস, কাগজ, রংতুলির দাম বাড়ছে, বিক্রির বাজার প্রায় না থাকায় ভেঙে যাচ্ছে চাহিদা জোগানের সংযোগসূত্র। বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো চেপে বসেছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দাপট। পেটের দায়ে কত সম্ভাবনাময় শিল্পী তাই মাঝপথে ছবি আঁকাকে বিদায় জানিয়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।
শিল্পী তো তাঁর স্বভাব নিয়মেই ভাবুক বাউল, বাজার ভাবনা ভেবে শিল্প করার কথা ভাবতে বসলে, সব সময় শিল্প হয় না। বিশ্বায়নের যুগ, ঠেকে শেখার যুগ থেকে, দেখে শেখার যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। ক্যাতেলনের এই ‘কলা’ আমাদের আর একবার মনে করিয়ে দিল- কেবল উদ্যোগের অভাবে উত্তরের শিল্পের বাজার শুধু এপিটাফের লেখার মতোই পড়ে থাকে শিল্পের কফিন হয়ে।
(লেখক শিলিগুড়ির ভাস্কর এবং সাহিত্যিক)