নয়ারহাট: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকেবাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’ কিন্তু এই নদীতে বৈশাখ মাসে হাঁটু জল দূরের কথা, পায়ের গোড়ালি ভেজানোর জলই থাকে না। একসময় যে নদীতে মাছ শিকার করে শয়ে-শয়ে মৎস্যজীবীদের জীবন এবং জীবিকা নির্বাহ হত। কালের কবলে এখন সেই নদীর মৃতপ্রায় অবস্থা। নদীর নাম মরা সুটুঙ্গা। নদীটি যেন আক্ষরিক অর্থে মরে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় মাছের আকাল দেখা দিয়েছে।
সংকটে পড়ে অনেক আগে এলাকার মৎস্যজীবীদের একাংশ জীবিকা বদলে ফেলেছেন। মৎস্যজীবীদের কেউ আজ পরিযায়ী শ্রমিক, কেউ দিনমজুর, কেউ বা অটো-টোটো চালিয়ে দিনযাপন করছেন। নদীটি বাঁচাতে প্রশাসনের তরফে কোনও উচ্চবাচ্য চোখে না পড়ায় স্থানীয় স্তরে আক্ষেপ রয়েছে। নদী সংস্কারের দাবিও উঠেছে। মরা সুটুঙ্গা ছোট নদী। দৈর্ঘ্যে খুব কমবেশি আট কিমি। সামান্য গতিপথে নদী প্রচুর বাঁক নিয়েছে। কানফাটা এলাকা থেকে তিন-চারটি গ্রাম পেরিয়ে পশ্চিম খাটেরবাড়িতে সুটুঙ্গা নদীতে গিয়ে মিশেছে।
এই সময়টাতে নদীর কোনও কোনও অংশে হাঁটুজল থাকলেও মাস তিনেকের মধ্যে তা শুকিয়ে যায়। এখন গোটা নদীজুড়ে কচুরিপানার আস্তরণ। নদীবক্ষ দখল করে বোরো ধানচাষের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বীজতলায় ছেয়ে গিয়েছে নদীর বিরাট অংশ। স্থানীয়দের আশঙ্কা, সংস্কারে দ্রুত কোনও উদ্যোগ নেওয়া না হলে নদীবক্ষ কৃষিজমি এবং খেলার মাঠে পরিণত হতে খুব দেরি নেই। মাথাভাঙ্গা-১ বিডিও শুভজিৎ মণ্ডলের বক্তব্য, ‘নদী সংস্কারের বিষয়টি সেচ দপ্তরের এক্তিয়ারভুক্ত।’ যদিও এ ব্যাপারে সেচ দপ্তরের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
মাথাভাঙ্গা নদী বাঁচাও কমিটির সম্পাদক তন্ময় চক্রবর্তীর কথায়, ‘ছোট ছোট নদীগুলি বাঁচাতে প্রশাসনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’ উচিত হলেও কোনও পদক্ষেপ না করায় সংগঠনের তরফে আন্দোলনের ভাবনাচিন্তা রয়েছে।
শিকারপুরের হাজিরদোকান এলাকায় মরা সুটুঙ্গা নদীর ওপর পাকা সেতুতে দাঁড়ালে চোখে পড়ে, কচুরিপানার দখলদারিতে মজে গিয়েছে নদীর বুক। গতিপথ রুদ্ধ। সুভাষ বর্মন, সুব্রত বর্মনের মতো মৎস্যজীবীদের আক্ষেপ, একসময় বছরভর নদীতে জল থাকত। পুঁটি, সাটি, ট্যাংরা, শাল, শিঙি, মাগুরের মতো দেশীয় মাছ নদীতে দেদার মিলত। মাথাভাঙ্গা শহরের মাছ বাজারে সেসব মাছের চাহিদাও ছিল ব্যাপক। এখন সেই সোনালি অতীতের দিনগুলি মনে করে এখনও দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সুভাষ বর্মনরা।
পশ্চিম খাটেরবাড়ির বাসিন্দা ৫৭ বছরের শামসুল হক বলেন, ‘ছোটবেলায় ফাল্গুন-চৈত্র্য মাসে জল কমলে শখ করে ওই নদীতে হাত দিয়ে নদিয়ালি মাছ ধরতাম। যা স্বাদে গুণে ছিল ভরপুর। এখন নদীর এই অবরুদ্ধ দশা দেখে কষ্ট হয়।’ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত পরিবেশপ্রেমী সংস্থা ‘জিকো’-র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক তাপস বর্মনও। তিনি জানান, নদীর বুকে চাষাবাদ হওয়ায় জৈববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে বাস্তুতন্ত্রও।