রামপ্রসাদ মোদক, রাজগঞ্জ: স্বামী কি এই ভালোবাসার সপ্তাহে গোলাপ দিলেন? এই প্রশ্নে লাজুক হেসে ফেললেন জলপাইগুড়ির (Jalpaiguri) রাজগঞ্জ (Rajganj) ব্লকের সুখনী গ্রাম পঞ্চায়েতের মালিপাড়ায় মন্দাকিনী বিশ্বাস। তাঁর কথায়, ‘ভালোবাসার সপ্তাহ কী, সেসব জানি না। বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে একজন অন্ধ মানুষের অবলম্বন হয়েছি, সেই আমার ভালোবাসা। তার পাশে থাকাই আমার কাছে ভালোবাসা।’
একটা সরল মুখ, দু’চোখে বিশ্বাস আর স্বামীকে ভালো রাখার জেদের কাছে ফিকে হয়ে যায় ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-এর উন্মাদনা। মন্দাকিনীর প্রাণবন্ত হাসি দেখে কে বলবে দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে কাটিয়েছেন। কিন্তু তাতে কি ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়েছে? পালায়নি। স্বামীর ঘরের বেড়া ভাঙা হলেও সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছে। ভুল প্রমাণ করেছেন, ‘অভাব যখন দুয়ারে এসে দাঁড়ায় ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়’ প্রবাদটিকে।
বছর পঁচিশ আগে মন্দাকিনীর বিয়ে হয় সুভেন বিশ্বাসের সঙ্গে। আর পাঁচটা সচ্ছল পরিবারের মতো তাঁরাও ভালো সময়ের অপেক্ষায় কাটিয়ে ফেলেছেন এই দীর্ঘ সময়। আজ পর্যন্ত তাঁরা কেউ কাউকে গোলাপ দেননি। তারপরেও টিনের ঘরের প্রতি কোণে রয়েছে একে অপরের প্রতি ভালোবাসার টান।
মন্দাকিনী বলেন, ‘জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই মানুষটার সঙ্গে থাকব। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, যে দায়িত্ব আমি পেয়েছি তা যেন সারা জীবন পালন করে যেতে পারি।’
বিয়ের পর থেকেই সংসারের দায়িত্ব সুভেনের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন মন্দাকিনী। পাশের চা পাতা কারখানায় মরশুমি শ্রমিকের কাজ করেন। সুভেন গ্রামের হাটগুলিতে লটারির টিকিট বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন তাঁর পুঁজি শেষ হয়ে যাওযায় সেই কাজ হারিয়েছেন। অপেক্ষায় আছেন ভালো দিন আসবে।
দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তাঁদের সংসার। আর্থিক অনটনে বড় ছেলেকে নবম শ্রেণির বেশি পড়াতে পারেননি। সে এখন চা পাতা পরিবহণের গাড়িতে শ্রমিকের কাজ করে। বাড়িতে রয়েছেন সুভেনের মা। এতগুলো মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দিব্যি হাসিমুখে দিন কাটাচ্ছেন মন্দাকিনী। আর্থিক কষ্ট নিয়ে অভিযোগ করেননি সুভেনকে। আধপেটা খেয়ে কখনও সংসার ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি।
সুভেন বললেন, ‘আমার মতো জন্মান্ধের সঙ্গে মন্দাকিনী সাতপাক ঘুরেছে, এটা আমার সৌভাগ্য। চরম আর্থিক কষ্টে ভরসা দিয়েছে। ওর আশ্বাসই আমার লড়াইয়ের শক্তি। আমার মা ও সন্তানদের ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাবেনি। আমার পূর্বজন্মের পুণ্যফলে মন্দাকিনীকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছি।’
বর্তমানে কান পাতলেই শোনা যায় বিচ্ছেদের গল্প। হঠাৎ প্রেমের আনন্দ কয়েকমাসেই বদলে যায় ক্ষোভে। ঘৃণা হয়ে দাঁড়ায় অভিমানগুলো। সংসারের বিচ্ছেদের এত কাহিনীর মাঝে সুভেন-মন্দাকিনীরা মন ভালো করার খবর আনে। পরকীয়ার টান কিংবা অভাব যেখানে এত সংসার ভাঙছে সেখানে মন্দাকিনী-সুভেনের মসৃণ দাম্পত্য হোক ভ্যালেন্টাইন্সের সেরা উদাহরণ।