কৌশিক দাস, লাটাগুড়ি: ঘড়ির কাঁটা ১০টা বেজে ৪৫ মিনিট। বাস থেকে নেমেই ছুটতে ছুটতে স্কুলের পথে যাচ্ছেন গৌতম। সঠিক টাইমে স্কুলে ঢুকে জাতীয় সংগীতে অংশগ্রহণ করতে হবে যে। গত ৪০ বছর ধরে একদিনের জন্যও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। বছর চারেক আগে শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর নিলেও ছাড়তে পারেননি প্রিয় বিদ্যালয়কে। অবসরজীবনের আরাম ও সুখস্বাছন্দ্যকে অস্বীকার করে সুদূর জলপাইগুড়ি (Jalpaiguri) থেকে বাসে করে ঝুলতে ঝুলতে ৪০ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে লাটাগুড়িতে এসে আগের মতোই নিয়মিত পাঠদান করে চলেছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গৌতমকুমার ঘোষ।
গৌতমের পৈতৃক বাড়ি লাটাগুড়িতে। লাটাগুড়ি বিএফপি স্কুলেই ওঁর প্রাথমিক শিক্ষার পর্ব। এরপর ১৯৮৪ সালে সেই স্কুলেই শিক্ষকতার চাকরি পান। চাকরি পাওয়ার পর জলপাইগুড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। ২০২০ সালের ৩১ মার্চ করোনা পর্বে কর্মজীবন থেকে অবসর নেন তিনি। কিন্তু অবসর নিলেও প্রিয় বিদ্যালয়কে ছেড়ে থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। করোনার সময়েও নিয়মিতভাবে বিদ্যালয়ে এসে সহযোগিতা করেছেন।
জন্মগতভাবে পায়ের সমস্যা রয়েছে গৌতমের। তাতে শিক্ষাদানে কোনও খামতি নেই। অবসরের পর নিঃস্বার্থ এই শিক্ষাদানকে কত মানুষ কটূক্তি করেছেন। কখনও ‘পাগল’, ‘খ্যাপাটের’ মতো তকমা জুটলেও শিক্ষকতার নেশাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছেন তিনি।
সোম থেকে শনি ঠিক আগের মতোই পাবলিক বাসে ঝুলতে ঝুলতে গাঁটের কড়ি খরচ করে চলে আসেন স্কুলে। অনেক সময় দেখা যায় স্কুলের নিয়মিত শিক্ষকরাও সেই সময় হাজির হননি। নিজেই স্কুলের তালা খুলে স্কুলের যাবতীয় কাজ শুরু করে দেন। গৌতমের কথায়, ‘এই স্কুলেই আমি পড়েছি আবার এখানেই পড়ুয়াদের পড়াতে পারছি এটা আমার সৌভাগ্য। স্কুলের প্রতিটি ইট, বালি, পাথরের সঙ্গে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক। কোনও কিছু প্রাপ্তির আশা আমি করি না। যতদিন শরীর সঙ্গ দেবে বাচ্চাদের পড়িয়ে যাব।’
ওই স্কুলের শিক্ষিকা মৌমিতা দে’র কথায়, ‘উনি আমার অভিভাবকের মতো। স্কুলের প্রতি ওঁর ত্যাগ আমাদের শেখায়। এমন মানুষের সঙ্গে থাকতে পেরে আমি ধন্য।’
লাটাগুড়ির বাসিন্দা মুকুল চন্দ বলেন, ‘গৌতমবাবুর মতো আদর্শ শিক্ষক বর্তমান সময়ে বিরল। আমরা লাটাগুড়িবাসী এমন মানুষকে পেয়ে গর্বিত।’
জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক শ্যামলচন্দ্র রায় বলেন, ‘অবসরের পরেও পড়ুয়াদের স্বার্থে গৌতমবাবু শিক্ষাদান করে চলেছেন যা জলপাইগুড়ি জেলাতে নজির। ওঁর এই উদ্যোগকে আমরা সম্মান জানাই। এমন শিক্ষক সমাজের গর্ব।’