পূর্ণেন্দু সরকার, জলপাইগুড়ি: জলপাইগুড়ি (Jalpaiguri) জেলার শতাধিক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের একটিরও ‘হেরিটেজ’ (Heritage) স্বীকৃতি মেলেনি। এমনকি কোচবিহার হেরিটেজ শহর হলেও এখানকার প্রাচীন নির্মাণগুলি নিয়ে গত এক দশকে কোনও পদক্ষেপ করেনি রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। যদিও ২০১১ সালে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনকে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তরবঙ্গজুড়ে সম্ভাব্য হেরিটেজ তালিকা তথ্য ও ছবি সহকারে পাঠিয়েছিল। আজও জলপাইগুড়ির ক্ষেত্রে সেই স্বীকৃতি অথই জলে।
রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সদস্য জলপাইগুড়ির ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষ বলেন, ‘১০০ বছর বা তার বেশি পুরোনো সম্পত্তি বা স্থাপত্যকে হেরিটেজ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আমি কমিশনের সদস্য হওয়ার পর একটি বৈঠকে অংশ নিয়েছিলাম।’
জলপাইগুড়ি শহরে শিক্ষা দপ্তরের অধীনে থাকা পূর্ত দপ্তরের বিপরীতে কোচবিহার মহারাজার তৈরি করা আয়রন হাউস আজ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। চা বাগানের সাহেবদের তৈরি ক্লাব রোডের ইউরোপিয়ান ক্লাবের অবস্থাও জরাজীর্ণ। তেলিপাড়ার তত্ত্ববিদ্যা ভবনের বারান্দায় চায়ের দোকান বসে। সমাজপাড়ার আর্যনাট্য ভবনের পুরানো মঞ্চ খুলে নতুন করে করা হয়েছে। ভবনের মাঠ ঐতিহাসিক স্বাধীনতা আন্দোলনের সভা সমিতির স্মৃতি নিয়ে অযত্নে পড়ে রয়েছে। নয়াবস্তির প্রাচীন ব্যাপটিস্ট চার্চ নিজেদের অসুবিধার কথা ভেবে প্রাচীন কাঠামো ভেঙে নতুন গির্জা বানিয়েছে। কালেক্টরেট রোডে সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড অল অ্যাঞ্জেল চার্চটি এখনও অপেক্ষায় আছে কবে হেরিটেজ স্বীকৃতি মিলবে। বৈকুণ্ঠপুর রাজপ্রাসাদের এক অংশ এখন খণ্ডহর। অন্য অংশ মেরামত করে পরিবারের লোকজন থাকেন। রাজবাড়ির হেরিটেজ সম্পত্তি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চে মামলা চলছে। শুধু জলপাইগুড়ি শহরের সম্ভাব্য হেরিটেজ নির্মাণের ছবিটা এতটাই বিবর্ণ।
ময়নাগুড়ির জল্পেশ মন্দির, বটেশ্বর, জটিলেশ্বর মন্দির, সদরখৈ-এর মতো শৈবতীর্থ ছাড়াও চালসা পোলো ক্লাব, মালবাজার মহকুমার একাধিক প্রাচীন গির্জা, সামসিংয়ের গুম্ফা থেকে চা কর সাহেবদের কবরখানা ও কয়েকটি মসজিদ সহ জলপাইগুড়ির ৪২টি হেরিটেজ নির্মাণের তালিকা রাজ্য হেরিটেজ কমিশনে জমা পড়েছিল ২০১১ সালে। পরে জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন থেকে সেই তালিকা বাড়িয়ে শতাধিক করা হয়েছিল। তারপর থেকে আর কোনও আগ্রহই দেখায়নি রাজ্য হেরিটেজ কমিশন।
জলপাইগুড়ির প্রাক্তন বিধায়ক গোবিন্দ রায় বলেন, ‘রাজবাড়ি ছাড়াও শিব, মনসা, কলা মন্দির, মেলার মাঠ, দুটি গেট, দিঘি সহ ফাঁকা জায়গাগুলিকে হেরিটেজ ঘোষণা করে সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া উচিত।’
আর্যনাট্য সমাজের কাঠের মঞ্চে শিশির ভাদুড়ি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, কেলুচরণ মহাপাত্রর মতো দিকপালরা অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা হল, রাজ্য হেরিটেজ কমিশন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালকেই উত্তরবঙ্গের নোডাল এজেন্সি করে হেরিটেজ সম্পত্তির তালিকা পাঠাতে বলেছিল। তারজন্য অর্থ বরাদ্দও করেছিল কমিশন। সেইসময় থেকে গত বছর অক্টোবর পর্যন্ত কমিশনে উত্তরবঙ্গ থেকে একজন প্রতিনিধিকেও রাখা হয়নি।
গত নভেম্বরে আনন্দগোপাল ঘোষকে সদস্য করা হয়। কিন্তু এতদিনেও একবারের জন্য প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে বা জলপাইগুড়ি নিয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত তালিকা সরেজমিনে খতিয়ে দেখেনি কমিশন।