পূর্ণেন্দু সরকার, জলপাইগুড়ি: গত এক বছরে খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে উত্তরবঙ্গে। সেইসঙ্গে পকসো মামলার সংখ্যাও বেড়েছে। জলপাইগুড়ির (Jalpaiguri) আঞ্চলিক ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২২-’২৩-এ খুন-ধর্ষণের ৩৮০০ ঘটনার নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে এসেছিল। ২০২৩-’২৪-এ সেই সংখ্যাটা ৬০০০ ছুঁয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই উত্তরবঙ্গে নারী নিগ্রহ এবং খুনের মতো অপরাধের সংখ্যা এভাবে বাড়তে থাকায় উদ্বিগ্ন পুলিশ ও প্রশাসনের শীর্ষ মহল। কী জন্য ‘শান্ত’ উত্তরবঙ্গ এমন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে, তার হদিস করতে চাইছে প্রশাসন।
জলপাইগুড়িতে উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবের অধীনে কোচবিহার থেকে মালদা পর্যন্ত আটটি জেলা রয়েছে। ফরেন্সিক ল্যাব সূত্রেই জানা গিয়েছে, এখানে বায়োলজি, টক্সিকোলজি এবং সেরোলজিক্যাল নমুনা পরীক্ষা চালু হয়েছে। মালদা থেকে কোচবিহার পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের আট জেলা থেকে আসা খুন, ধর্ষণ, পকসো মামলার নমুনা ছাড়াও অন্যান্য নমুনার পরীক্ষা করা হয়। রক্তের গ্রুপ ও অন্য নমুনা, খুন করা অস্ত্রে লেগে থাকা রক্ত, সিরাম, ভিসেরা, মানুষের শরীরের চামড়া, চোখের জল, সিমেন, বিষক্রিয়ার নমুনা, অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাস্থলের নমুনা পরীক্ষা করা হয় এখানকার ল্যাবরেটরিতে।
গবেষণাগার সূত্রে জানা গিয়েছে, বায়োলজি, সেরোলজি ও টক্সিকোলজি বিভাগ মিলিয়ে ২০২২ সালে বছরে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ৩০০০-এর মতো। ২০২৩ সালে তার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮০০। আর ২০২৪-এ সেই সংখ্যা ছুঁয়েছে ৬০০০। চলতি বছরের পরিসংখ্যানও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত গড়ে প্রতি মাসে খুন, ধর্ষণ সহ অন্য মামলার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫০০টির মতো। তার মধ্যে ৭৫ শতাংশ নমুনাই খুন ও ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনার। শুধু তাই নয়, গত এক বছরে পকসো মামলার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। দুই-তিন বছর আগে পকসো মামলার নমুনা মাসে একটি, বড়জোর দুটি করে আসত। গত এক বছরে প্রতি মাসেই পকসো মামলার নমুনা আসছে মাসে ৫ থেকে ৬টি করে।
জলপাইগুড়ির আঞ্চলিক ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির সহকারী অধিকর্তা ও ইনচার্জ ডাঃ মৌসুমি রক্ষিত জানান, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা এভাবে বেড়ে যাওযায় কাজের চাপও মারাত্মক বেড়েছে। এমনিতেই ল্যাবরেটরিতে এক-তৃতীয়াংশ কর্মী কম। তার উপর ভারতীয় ন্যায়সংহিতার নতুন আইনে কোনও মামলায় সাত বছরের ওপর সাজা হওয়ার ধারা থাকলে সেই মামলার ক্রাইম সিন সরেজমিনে পরিদর্শন করা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার খান্ডবাহালে উমেশ গণপত বলেন, ‘গত দু’বছরে নথিভুক্ত পকসো মামলার মধ্যে ১৫টি মামলায় অভিযুক্তদের সাজা দিয়েছে আদালত।
পুলিশ যথাসময়ে দ্রুততার সঙ্গে সমস্ত তদন্ত রিপোর্ট আদালতে পেশ করেছে। এই বছর কয়েকমাসে একটি ডাকাতি ও চারটি খুনের ঘটনার তদন্ত দ্রুত শেষ করে আদালতে প্রয়োজনীয় রিপোর্ট ও তথ্যপ্রমাণ জমা দিয়েছে পুলিশ। সময়মতো আদালত সাজাও ঘোষণা করেছে।
তবে পকসো মামলা কেন বাড়ছে, কীভাবে মানুষকে সচেতন করা যায় তা নিয়ে আমরা প্রশাসনের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি।’
উত্তরবঙ্গের আটটি জেলার মধ্যে সাধারণ ও রাজনৈতিক খুনের ঘটনার নমুনা সবচেয়ে বেশি আসছে মালদা ও কোচবিহার থেকে। এই দুটি জেলাতেই জনবিন্যাস মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসনের। পুলিশের এক পদস্থ অফিসার জানান, সর্বত্র সামাজিক অবক্ষয় ক্রমাগত বাড়ছে। নমনীয়তা ও সহনশীলতার মতো বিষয়গুলি হারিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে হিংসা, পারিবারিক বিবাদ।
সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে সাধারণ মানুষের বড় অংশ প্রভাবিত হচ্ছে। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন বাড়ছে। শুধুমাত্র অভিযুক্তকে সাজা দিলেই সামাজিক অবক্ষয় আটকানো যাবে না। প্রয়োজন সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার।
জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিক সুদীপ ভদ্র বলেন, ‘পকসো মামলা উদ্বেগজনকভাবেই সর্বত্র বাড়ছে। এটার অন্যতম কারণ অবশ্যই সামাজিক অবক্ষয়। ৫-৭ বছরের শিশুর সঙ্গে বয়স্ক যারা যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধমূলক কাজ করছে তারা বিকৃত মানসিকতার। সোশ্যাল মিডিয়ায় খারাপ কিছু দেখে অনেক বয়স্ক লোকও প্রভাবিত হচ্ছে। এমন ঘটনা যাতে না বাড়ে তার জন্য আমরাও প্রচার করছি।’