শুভজিৎ দত্ত ও রহিদুল ইসলাম, মেটেলি: মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান নিয়ে বাংলাদেশের বক্তব্য অনেকটাই ঘুরে গিয়েছে। যদিও তাতে পরোয়া নেই ডুয়ার্সের (Dooars)। এখনও এখানে কান পাতলে ভেসে আসে ভারতীয় সেনার অক্লান্ত পরিশ্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সেই গৌরবগাথা।
প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ইতিহাস বহন করছে জলপাইগুড়ির (Jalpaiguri) মেটেলি চা বাগানের (Matelli Tea Garden) মূর্তি ডিভিশনে নদী লাগোয়া মাঠটি। সেখানে ১৯৭১ সালে কয়েক মাস ধরে মোট দু’দফায় ১৩২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। ৬১ জনের প্রথম ব্যাচে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামাল। এখনও মূর্তির ওই নিরিবিলি প্রান্তরে গেলে ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। দেখা যাবে প্রশিক্ষণ শিবিরের জন্য তৈরি করা জলের ট্যাংক। বঙ্গীয় ইতিহাস পরিষদের সভাপতি আনন্দগোপাল ঘোষ বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া কিংবা বাংলাদেশিদের আশ্রয়, বেশিরভাগ শিবিরই হয়েছিল উত্তরবঙ্গে। এর একটি কারণ অবশ্যই সীমান্তের নৈকট্য। তবে ভৌগোলিক, ভাষাগত, খাদ্যাভাস এবং সংস্কৃতির সাদৃশ্যও ছিল অন্যতম ফ্যাক্টর। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর জেলাজুড়ে শিবিরগুলি গড়ে ওঠে।’ তাঁর সংযোজন, ‘বাংলাদেশিরা এখন কী বলছেন, তা নিয়ে আগ্রহ নেই।’
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘মূর্তির ৬১, মুক্তির ৭১’ ওয়ারকোর্স স্মারক গ্রন্থটিতে চা বাগান ঘেরা ওই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কথা সবিস্তারে লেখা আছে। ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষ এবং তাঁর ছাত্র ডঃ কালীকৃষ্ণ সূত্রধরের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে উত্তরবঙ্গের অবদান’ নামে ৪০০ পাতার একটি বইতেও যাবতীয় তথ্য এবং কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে।
পাশাপাশি রয়েছেন জীবন্ত সাক্ষীও। যেমন, মেটেলি চা বাগানের বাঁশলাইনের ঝাড়িয়া ধানোয়ার। বৃদ্ধ বললেন, ‘মূর্তির ওই শিবিরের লঙ্গরখানায় খাবার তৈরি করতাম। মূর্তি নদীর পাশে আমাদের সেনারা ওঁদের ট্রেনিং দিত। সেসব তো আমার নিজের চোখে দেখা।’ উত্তরবঙ্গের চা বাগান বিশেষজ্ঞ রামঅবতার শর্মা জানান, সেসময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ডুয়ার্সের অনেকেই আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। নাগরাকাটা হাইস্কুলে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। চাঁদা তুলে সবার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
তথ্য বলছে, মূর্তিতে যাঁরা প্রশিক্ষণ নেন তাঁরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে বিভিন্ন সেক্টর থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এদের মধ্যে পরে বীরত্বের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রথম ব্যাচের ১৭ জনকে বীরসূচক খেতাব দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর ওই শিবির থেকে প্রথম ব্যাচের ক্যাডেটরা পাশআউট হয়। বানারহাট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুকল্যাণ ভট্টাচার্য ডুয়ার্সের ইতিহাসের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চর্চা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ওই পাশিং আউট প্যারেডে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গণি প্রমুখ ছিলেন। যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনতে আমাদের এত বড় অবদান, সেখানে সেই দেশের ভারত বিদ্বেষী মনোভাব কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।’