আলিপুরদুয়ার

কূল ছাপিয়ে বর্ষায় আতঙ্ক ‘ডুয়ার্সের রানি’ জয়ন্তী

মণীন্দ্রনারায়ণ সিংহ, আলিপুরদুয়ার : বাড়ি থেকেই তো দেখা যায় জয়ন্তী নদী। সেই জয়ন্তীরই বাঁধের উপর ভেজা কাপড় নদীর হাওয়ায় শুকোচ্ছিলেন মালা প্রসাদ। সামনে পাহাড়ের কোলে তখন ঘনঘটা। আলোছায়ায় মায়াবী পরিবেশ। সেকথা বলতেই মাঝবয়সি মালার ভুরু কুঁচকে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘অন্যেরা বলে জয়ন্তী নাকি ডুয়ার্সের রানি। এই রানিই এখন আমাদের কাছে ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

আসলে মালা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না গত বছরের কথা। এরকমই এক বর্ষার দিনে রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ বাঁধ উপচে জল ঢুকে পড়েছিল গ্রামের বাড়িগুলিতে। তখন আতঙ্কে সবকিছু ছেড়ে পরিজনদের প্রাণ বাঁচাতেই  তাদের নিয়ে জয়ন্তী হাইস্কুলের দিকে চলে গিয়েছিলেন মালারা। বলছেন, ‘সেদিন যদি আরও কিছুক্ষণ নদীর জলের ওই গতি থাকত তাহলে হয়তো সে রাতে আমাদের ঘরবাড়ির অস্তিত্বই থাকত না।’ মালার এখানেই জন্ম, এখানেই বেড়ে ওঠা, এখানেই বিয়ে। তাও বলছেন, ‘আগে কোনওদিন ওই দৃশ্য দেখিনি। তাই বর্ষা এসেছে, এখন একটু বৃষ্টি হলে দু’চোখের পাতা এক করতে পারি না।’ বাড়ির সামনে ছাতা মাথায় বাঁধে দাঁড়িয়ে চঞ্চলা জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করলেন, হে মহাদেব তুমিই আমাদের রক্ষা করো প্রভু।

জয়ন্তীর বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব কমল বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ ওরাওঁদের মুখেও একই ভয়ের কথা। বললেন, নদীখাত এখন আমাদের গ্রামের থেকে অনেক বেশি উঁচুতে রয়েছে। গ্রামরক্ষায় একটা ছোট্ট বাঁধ মাঝখানে রয়েছে বটে, সেটার মেরামতি করা বা উঁচু করার কোনও সরকারি উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে বাঁধ ভেঙে গ্রামে জল ঢোকাই শুধু নয়, নদীর গতিপথও যে কোনও সময় বদলে যেতে পারে। তাঁরা ভয় পাচ্ছেন, কোনদিন পথ বদলে নদী না গোটা গ্রামটাকেই ধুয়েমুছে সাফ করে দেয়।

ওই এলাকার বাসিন্দাদের জীবিকা পর্যটননির্ভর। বাড়িতেই দু’একটি ঘর হোমস্টে হিসেবে ব্যবহার করে, কেউ বা খাবারের হোটেল চালিয়ে সংসার চালান। তবে সরকার কি এখানকার পর্যটনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও উদ্যোগ নিয়েছে? হোমস্টেগুলির মালিকরা মানতে চাইছেন না।

গত কয়েক বছর ধরে নদীর বুক থেকে বালি-পাথর না তোলায় নদীখাত এখন অনেকটাই উঁচুতে উঠে গিয়ে এখন তাঁদের গ্রাম নীচু হয়ে গিয়েছে। নদী গ্রামকে একবার গ্রাস করলে বাসিন্দাদের অস্তিত্ব শুধু নয়, বনাঞ্চলও ধ্বংস হয়ে যাবে। বন্যপ্রাণ ক্ষতির মুখে পড়বে। কালচিনির বিএলআরও সেরপ শেরপা বলেন, জয়ন্তী নদী বন দপ্তরের কোর এলাকায় রয়েছে। সেখানে বালি-পাথর উত্তোলনের এক্তিয়ার একমাত্র বন দপ্তরেরই রয়েছে। যদিও বন দপ্তরের তরফে জানানো হয়েছে, জয়ন্তী নদীর বুক থেকে বালি-পাথর তোলার ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। তবে কাজ হবে কবে? এপ্রশ্নের জবাব মেলেনি।

১৯৯৩ সালের ভয়াবহ বন্যার পর জয়ন্তী নদী চওড়া হতে শুরু করে। ২০১৮ সালের পর নদীর বুক থেকে পাথর তোলা বন্ধ হওয়ায় নদীর বেড উঁচু হতে থাকে। পাহাড়ি খরস্রোতা নদী থেকে বালি-পাথর না তোলায় জয়ন্তীবাসী আজ বিপন্ন। তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ন্তীর বুথ সভাপতি শেখর ভট্টাচার্য জানালেন, ‘ভারত-ভুটান নদী কমিশন থেকে জেলা প্রশাসন, কেউ আমাদের নিয়ে ভাবে না।’ জয়ন্তীর যুবক শুভজ্যোতি বসু আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমাদের এলাকাছাড়া করার একটা চক্রান্ত চলছে। তাই নদীবাঁধ উঁচু হয় না, নদীর বুকে পাথর জমতে জমতে পাহাড় হয়ে গেলেও তা তোলা হয় না। শতাব্দীপ্রাচীন জয়ন্তী গ্রাম বিপন্ন হলে জয়ন্তীর বনাঞ্চল, বন্যপ্রাণীরাও মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হবে, সেদিকেও কারও হুঁশ নেই।’

এখানে বাঘ ছাড়া হবে। বাসিন্দারা সেই কথা শুনেছেন। তাঁরা পালটা বলছেন, আগে যখন রেলপথ ছিল, বসতি ছিল, ডলোমাইট তোলা হত, তখনও বক্সার জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উপস্থিতি ছিল। বক্সা টাইগার রিজার্ভ ঘোষণার পর বাঘের শরীরী উপস্থিতি কোথায়? প্রশ্ন তাঁদের।

মুছে যাওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা জয়ন্তী গ্রামেও অবশ্য ভোটের হাওয়া লেগেছে। সেখানেও শাসক-বিরোধী দলগুলির রাজনৈতিক প্রচার শুরু হয়েছে। আর শাসকদলের প্রার্থী থেকে বিরোধী দলের প্রার্থীর দাবি একটাই, জয়ন্তী গ্রামকে বাঁচাতে অবশ্যই পাথর তুলতে হবে নদীর বুক থেকে। নেতারা বলছেন, ভোটপর্ব মিটলে তাঁরা রাজনৈতিক বিভাজন সরিয়ে রেখে সেই দাবিতে দরবার করতে ছুটবেন প্রশাসন ও বন দপ্তরের কাছে। জয়ন্তী গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী লালন মাহাতো আর বিজেপির গোবিন মাহাতো দুজনেই সহপাঠী। আবার ভালো বন্ধুও। দুজনের একটাই কথা, মানুষ যাকে খুশি ভোট দিক,  গ্রাম বাঁচাতে আমরা একসঙ্গে লড়ব।

প্রায় ১২০০ মানুষের বসবাস জয়ন্তী গ্রামে। এখানে কেউ হোমস্টে চালান, কেউ গাইড, কেউ সাফারি চালিয়ে বা ছোট দোকানপাট চালিয়ে জীবিকানির্বাহ করেন। নদীর পাথর সরালে কী হবে? বাসিন্দারা বলছেন, নদীর বুকে জমা পাথর উঠলে সারাবছর নদীতে জল মিলবে। এতে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতে পারে সরকারের। স্থানীয় শ্রমিকরা কাজ পাবেন। নদীতে জল পেলে বন্যপ্রাণীরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

Sourav Roy

Sourav Roy working as a Journalist since 2013. He already worked in many leading media houses in this few years. Sourav presently working in Uttarbanga Sambad as a Journalist & Sud Editor of Digital Desk from March 2019 in Siliguri, West Bengal.

Recent Posts

Ramayana | রামের বেশে নতুন লুকে রণবীর, সীতার চরিত্রে কে?

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: নতুন ছবির লুক ফাঁস হল রনবীর কাপুরের। শনিবার নীতেশ তিওয়ারির নতুন…

1 hour ago

Viral | হুবহু নরেন্দ্র মোদির মতো দেখতে! ফুচকা বিক্রেতাকে দেখে অবাক নেটপাড়া

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ফুচকা বিক্রি করে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতোই দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু…

3 hours ago

ব্রেকফাস্টে স্বাস্থ্যকর কিছু খেতে চান? বানিয়ে নিন ‘রাগি ওয়াফেল’

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: রোজ রোজ একই ব্রেকফাস্ট খেতে কারোরই ভালো লাগে না। রোজকার খাবার…

3 hours ago

Malda | সরকারি কাজে নিযুক্ত ঠিকাদারের কাছে তোলা আদায়ের চেষ্টা, প্রাণে মারার হুমকি!

সৌরভ কুমার মিশ্র, হরিশ্চন্দ্রপুর: এলাকায় সরকারি কাজ করছিলেন এক ঠিকাদার। আর সেই কাজের জন্য ছয়…

3 hours ago

Raiganj | পুকুর ভরাট করছে শাসকদলের লোকজন! হুঁশ নেই প্রশাসনের

রায়গঞ্জ: ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর জিতেন্দ্র সিং বনাম ভারতের পরিবেশ মন্ত্রকের মামলায় রায়ের ১৮-২১ অনুচ্ছেদে…

3 hours ago

Malda | দক্ষিণ মালদায় নির্বাচনি প্রচারে ঝড় প্রার্থীদের

মালদা: দ্বিতীয় দফার নির্বাচন শেষ। এবার লক্ষ্য তৃতীয় দফার নির্বাচন (Loksabha Election 2024)। সমস্ত রাজনৈতিক…

3 hours ago

This website uses cookies.