অশোক ভট্টাচার্য
১৮৭২ সালের জনগণনা থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলার জনসংখ্যার অর্ধেক ছিল মুসলমান। এদের বেশিরভাগ বসবাস করতেন বাংলার পূর্বাংশে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, পাবনা, বগুড়া, বাখরগঞ্জ, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ইত্যাদি জেলায়। বাংলার মুসলমানরাই ছিল আর্থসামাজিক দিক দিয়ে সবচাইতে বেশি পশ্চাৎপদ। এঁদের বেশিরভাগই থাকতেন পূর্ব বাংলার নীচু, জলাভূমি অঞ্চলে বা নদীর চরে। পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের অধিকাংশের জীবিকা ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদারদের অধীনে ভাগচাষি বা বর্গাদার এবং কৃষি শ্রমিকের কাজ।
জনসংখ্যাগতভাবে মুসলমানদের প্রাধান্য থাকলেও অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে তার কোনও প্রভাব প্রতিফলিত হত না। কয়েকটি উদাহরণে আসা যেতে পারে। যেমন, ময়মনসিংহের ৭০ ভাগ মানুষ ছিল মুসলমান, অথচ জমির মালিকানা ছিল মাত্র ১৬ শতাংশের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে। বাখরগঞ্জে মুসলমানদের হার ছিল ৬৪.৮ ভাগ, অথচ মুসলমানদের হাতে জমির মালিকানা ছিল মাত্র ১০ ভাগ। পাবনা জেলার শতকরা ৯ ভাগ মানুষ ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু। একচ্ছত্র জমির মালিকানা ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতেই।
এই তথ্য বলছে, পূর্ব বাংলায় উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ছিলেন সব দিক দিয়ে এগিয়ে। এবারে হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা নমশূদ্র, তাঁদের মধ্যে ৭৫.১৮ শতাংশ বসবাস করতেন অবিভক্ত বাংলার ৬টি জেলায়। এগুলি হল বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোহর ও খুলনা জেলায়। অবিভক্ত বাংলায় এই জাতিগোষ্ঠী বা নমশূদ্র সম্প্রদায়রা ছিলেন পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী।
জয়া চট্টোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দেবী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানীর গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশ ভাগের ফলে, বিশেষ করে বাংলা ভাগের ফলে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন এই নমশূদ্র সম্প্রদায় ও মতুয়ারা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতেও তাঁরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন সবচেয়ে বেশি। কারণ তাঁরাই সবচেয়ে বিলম্বে দেশ ভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গে আসেন। এপারে এসে তাঁরাই অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে সরকারি ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য হন। এঁরাই বেশি সংখ্যায় আন্দামান, দণ্ডকারণ্য, মানা, গুজরাট ইত্যাদি স্থানে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেন। এঁরাই যান মরিচঝাঁপিতেও।
বহু মানুষ বাংলা ভাগ প্রথমে চাননি। বাংলা ভাগের জোরালোভাবে দাবি করেছিল মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দু রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা কিছু ভদ্রলোক। মুসলিম লিগ চেয়েছিল কলকাতা সহ সম্পূর্ণ অবিভক্ত বাংলার পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। রাজ্য কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃত্ব বাংলায় মুসলমান আধিপত্যের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে কখনও কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। তিনবার জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন কখনও ফজলে হক, কখনও নিজামুদ্দিন, কখনও বা সুরাবর্দি। কখনও মন্ত্রীসভা গঠন করেছিল কৃষক প্রজা পার্টি, কখনও বা মুসলিম লিগের সমর্থনে। কখনও সমর্থন নিতে হয়েছে শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর দলের, কখনও বা তপশিলি জাতি ফেডারেশন পার্টির।
এই পার্টির দুজন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ও প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। যোগেন্দ্রনাথ কেন্দ্রীয় সরকারের অন্তর্বর্তী মন্ত্রীসভায় একবার আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন। হয়েছিলেন গণপরিষদেরও সদস্য। তপশিলি জাতি বা নমশূদ্রদের স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি পালন না করায় যোগেন মণ্ডল ও পিআর ঠাকুর সহ সকলে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলন ফজলে হক মন্ত্রীসভা থেকে।
এই সময় যোগেন্দ্রনাথের সঙ্গে কংগ্রেসের মতবিরোধ হয়। শিডিউল কাস্ট অ্যাসোসিয়েশন বিভক্ত হয়। যোগেন্দ্রনাথ স্বাধীনতার কয়েকবছর আগে ডঃ বিআর আম্বেদকরের নেতৃত্বে শিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯০৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়, এক নমশূদ্র কৃষক পরিবারে যোগেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৪ সালে অঙ্ক ও সংস্কৃতে উল্লেখযোগ্য নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। আর্থিক অনটন ছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করে বরিশালের বিএম কলেজে ১৯২৬ সালে তিনি আইএ-তে ভর্তি হন। ১৯২৯ সালে বিএম কলেজ থেকে অঙ্ক ও সংস্কৃত নিয়ে বিএ পাশ করেন। এরপর তিনি বিএল পাশ করেন ও আইন পেশাতে যোগ দেন। যোগেন্দ্রনাথের লক্ষ্য শুধু আইনজীবী হয়ে অর্থ উপার্জন ছিল না। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে গরিব ও দুঃস্থদের আইনি পরিষেবা প্রদান করতেন।
তিনি নির্বাচিত হন বরিশাল লোকাল বোর্ডের সদস্য। যুক্ত হন অশ্বিনীকুমার দত্তের সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তিনি যখন বিএম কলেজে পড়তেন, তখন থাকতেন নমশূদ্র হস্টেলে। সেই হস্টেলে থাকার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যোগেন্দ্রনাথ লেখেন- ‘আমি কলেজ সংলগ্ন নমশূদ্র হস্টেলে থাকিতাম, জেনারেল হিন্দু হস্টেলের ডাইনিং হলে নমশূদ্র ছাত্রগণের প্রবেশাধিকার ছিল না। এই ভেদ ও বৈষম্য আমার ভালো লাগিত না।…হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্যতার কারণ নির্ণয় করিতে গিয়া আমি বুঝিলাম যে, সমাজের নিম্ন শ্রেণির লোকেরা গরিব ও অশিক্ষিত। তাই ইহারা সমাজে উপেক্ষিত হয়।’
যোগেন্দ্রনাথ ছিলেন সুবক্তা। বিভিন্ন স্থানে পশ্চাৎপদ শ্রেণির মানুষের দাবির সমর্থনে বক্তৃতা দিতেন। ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইনসভায় নির্দল প্রার্থী হিসেবে অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইপো কংগ্রেস প্রার্থী সরল দত্তকে পরাজিত করে বিজয়ী হন। ১৯৩৭ সালে তিনি হয়েছিলেন আইনসভায় বিরোধী দলনেতা। পরে তিনি গঠন করেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট শিডিউলকাস্ট পার্টি। সেই সুবাদেই সংস্পর্শে আসেন শরৎচন্দ্র বসুর। সেই সময়ে ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর পরিচয়। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে বহু সভায় তিনি বক্তৃতা দিতেন।
১৯৩৭ সালে তিনি সহ ১২ জন তপশিলি জাতি বিধায়করা ফজলে হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। পরে ১৯৪১ সালে ফজলে হক মন্ত্রীসভাকে সমর্থন করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সমর্থন করেছিলেন ১২ জন তপশিলি জাতির বিধায়করাও। কিন্তু ফজলে হক মন্ত্রীসভা থেকে দুজন তপশিলি জাতির সদস্য কমিয়ে একজন করায় তাঁরা মন্ত্রীসভা থেকে আবার সমর্থন প্রত্যাহার করেন ও তাতে মন্ত্রীসভার পতন ঘটে।
এরপর গঠিত হয় নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভা। সেই মন্ত্রীসভায় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল হয়েছিলেন সমবায়মন্ত্রী। ১৯৪৬ সালের ২৮ মার্চ সোরাবর্দি মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। তাতে যোগেন্দ্রনাথ স্থান পান। কিন্তু তিনি বেশ কিছু শর্ত দিয়েছিলেন তপশিলি জাতির ছাত্রদের স্বার্থে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় যোগেন্দ্রনাথ দেশ ভাগ বা বাংলা ভাগের বিরোধিতা করেন, শরৎচন্দ্র বসুর প্রস্তাব সমর্থন করেন। পরে তিনি চলে যান পাকিস্তানে এবং যুক্ত হন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে। তিনি প্রথমে হন পাকিস্তান কনস্টুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সদস্য, তারপর হন পাকিস্তানের আইন ও শ্রমমন্ত্রী। আম্বেদকরের সঙ্গে যোগেন্দ্রনাথের ছিল সুসম্পর্ক। সেই সময় আম্বেদকর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অল ইন্ডিয়া শিডিউলকাস্ট ফেডারেশন। বাংলায় তার শাখার সভাপতি হয়েছিলেন যোগেন্দ্রনাথ। ১৯৪৬ সালে আম্বেদকরের গণপরিষদের সদস্যপদ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। সেই সময় যোগেন্দ্রনাথ নিজের পদ ছেড়ে দিয়ে আম্বেদকরকে বাংলা থেকে গণপরিষদে পাঠান। যোগেন্দ্রনাথ ১৯৪৭ সালের মে মাসে বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘বঙ্গ বিভাগ সমগ্র বঙ্গে তপশিলি জাতির সংঘবদ্ধতা ও জাতীয়তাবোধকে নির্মমভাবে ধ্বংস করিবে। সুতরাং তপশিলি জাতি এরূপ ক্ষতিকর ও ভয়ংকর প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারে না।’
শেষপর্যন্ত তিনি মুসলিম লিগ মন্ত্রীসভাকে সমর্থন করে পাকিস্তানে থেকে গেলেন। নিজেই লিখে গিয়েছেন- ‘ভারত বিভক্ত হইলে পূর্ববঙ্গে আমার নিজ জেলা বরিশাল পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আমি পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের কথা চিন্তা করিয়াই পাকিস্তানে থাকার সিদ্ধান্ত করি।’ যোগেন্দ্রনাথের যে আশা ছিল, কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সেই আশা পূরণ হওয়ার নয়। ইতিমধ্যে খুলনা ও কুমিল্লাতে শুরু হল বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে এক চিঠি লিখে তিনি জানান, পাকিস্তানে থাকা তাঁর মতো কোনও হিন্দুদের পক্ষেই নিরাপদ নয়। তাই তিনি ওই চিঠিতেই পাকিস্তান মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে একপ্রকার পালিয়ে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গে। একইসঙ্গে কয়েক লক্ষ নমশূদ্র, মতুয়া, তপশিলি জাতির মানুষও চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গে।
তিনি পশ্চিমবঙ্গে এসে যুক্ত হন উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলনে। যুক্ত হন ইউসিআরসি’র সঙ্গে। কিছুদিন পরে তাঁর সঙ্গে নেতৃত্বের মতের মিল না হওয়ায় তিনি গড়ে তোলেন পৃথক উদ্বাস্তু সংগঠন। ১৯৫০ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার পর নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখতেন আম্বেদকরের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গেও আম্বেদকর প্রতিষ্ঠিত রিপাবলিকান পার্টির শাখা কমিটি গঠন করেছিলেন। ১৯৫২, ১৯৫৭, ১৯৬২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে এবং ১৯৬৭ সালে বারাসত লোকসভা থেকে বামপন্থীদের সমর্থন নিয়ে লড়াই করেছিলেন। অথচ ভারতে এসে কোনও নির্বাচনেই তিনি জয়লাভ করতে পারেননি।
১৯৫৬ সালে আম্বেদকরের মৃত্যু হয়। তারপর যোগেন্দ্রনাথ দিল্লিতে আম্বেদকর ভবনকে কেন্দ্র করে রিপাবলিকান পার্টিকে পুনর্গঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গেও নমশূদ্র ও তপশিলি জাতির মানুষকে নিয়ে আন্দোলন, সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইতিবাচক সাড়া পাননি। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, পঞ্চানন বর্মারা স্বাধীনতার আগে নমশূদ্র মতুয়া রাজবংশীদের নিয়ে নির্বাচনি রাজনীতিতে যতটা সাফল্য পেয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাজ্যে দলিত, জাতপাতের নির্বাচনি রাজনীতির কিছু সাফল্য পেলেও পশ্চিমবঙ্গে এই রাজনীতির কোনও প্রভাব আজও পড়েনি। দেশ ভাগের পর মতুয়া মহাসংঘকে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করলেও সাফল্য পাননি। ১৯৬৮ সালে যোগেন মণ্ডলের মৃত্যুর পর তাঁর হাতে গড়ে তোলা সংগঠন আজ পশ্চিমবঙ্গে অস্তিত্বহীন। আজ পশ্চিমবঙ্গে জাতভিত্তিতে নির্বাচনি রাজনীতি করা কঠিন। পশ্চিমবঙ্গ এক্ষেত্রে, আজও রয়েছে ব্যতিক্রমী রাজ্য হিসেবে।
(লেখক রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী)