শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

লাগে রহো ম্যাংগোভাই বার অ্যাট ল’

শেষ আপডেট:

রূপায়ণ ভট্টাচার্য

মঙ্গলগ্রহের নয়, কিউবা বা কেরল বা চিনেরও নয়। এই বাংলার এক ছাত্র নেতার কথা দিয়েই শুরু করা যাক।
ছোটবেলায় হাঁসের ডিম ঝুড়িতে নিয়ে যেতেন গ্রামে রবিবারের হাটে। ১৬টা ডিম বিক্রি করে জুটত এক টাকা। হাইস্কুলে টিফিনে চানাচুর বা নাড়ু খেয়ে খরচ হত এক আনা। বাকি পয়সা বাঁচত। ডিম না থাকলে? শনিবার বিকেলে পেঁয়াজকলি কাটতেন, রবিবার সকালে হাটে যেতেন। সঙ্গে ফুলকপি ও বেগুন। বিক্রির টাকায় কেনা হত খাতা-পেন্সিল।

আগেকার দিনে এই গল্পগুলো খুব সহজ মনে হত। এখন রূপকথার গল্প শোনায়। ওই কাহিনীর মূল চরিত্র সন্তোষ রানা। ফিজিক্সে এমএসসি-তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র গবেষণা করতে করতেই নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ‘গ্রামে চলো’র ডাকে চলে গেলেন মানুষের পাশে দাঁড়াতে।

তখন এমন সাধারণ হয়ে অসাধারণ ছাত্র নেতা অনেকই ছিলেন। মালদায় যেমন ছিলেন কুলদীপ মিশ্র। অসুস্থ মানুষদের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতেন কলকাতায়। সমাজসেবা করে বেড়াতেন। ওয়াগন ব্রেকারদের দাপট বন্ধ করতে গিয়ে নিজেই খুন হয়ে যান একদিন।

বৃহস্পতিবার সকালে কলকাতার কসবা আইন কলেজের সামনে দেখি, ফুটপাথের মন্দিরের গায়ে বট গাছের ছায়ায় টিভি বুম হাতে অপেক্ষায় চ্যানেলের সাংবাদিকরা। কখন কে আসে? বাইরে ব্যারিকেড। ভিতরে তিন পোশাকের পুলিশ– সাদা, হলুদ, চকরাবকরা। শুধু কলেজটা খুলবে কবে, কেউ জানেন না।

সেখানে দাঁড়িয়ে আগাপাশতলা ভাবতে ভাবতে সন্তোষ-কুলদীপদের জমানা মনে পড়ল। এখনকার কোনও ছাত্র নেতার ক্ষেত্রে এ কথা ভাবা যাবে? আজ আখের গোছাতে ওস্তাদ সব ছাত্র নেতা। নির্বাচনহীন ক্ষমতায় থেকে শুধু ভোগ এবং ভোগ। কলকাতার ম্যাংগো থেকে শিলিগুড়ির মার্ডার ও চাঁদ– ছাত্রজীবন কত যুগ আগে শেষ, তবু ছাত্র নেতা থেকে গিয়েছেন লজ্জাহীন। কলেজ সোশ্যালে মার্ডারের মাস্তানি দেখেছে শিলিগুড়ি। একই পাড়ার বাসিন্দা গৌতম দেব তাঁকে আয়ত্তে আনেননি বা আনতে চাননি।

মনোজিৎ ‘ম্যাংগো’ মিশ্র নামক অমানুষটি সম্পর্কে যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে, তাতে কিছু প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। আইন কলেজের সামনে ফুটপাথে পাঁউরুটি-ডিম-বিস্কুটের বিক্রেতারাও দেখলাম, ‘ম্যাংগো ভাই বার অ্যাট ল’-কে চেনেন।

ক) এই মানবিকতাহীন কুলাঙ্গারের কাণ্ড সম্পর্কে তৃণমূলের ঊর্ধ্বতন নেতারা কিছু জানতে ব্যর্থ কেন? শিক্ষামন্ত্রী নাটক নিয়ে এত ব্যস্ত, খবরই পান না? গড়িয়াহাট থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, এই কলেজের অনাচার লালবাজার-কালীঘাট-ক্যামাক স্ট্রিট না জানলে গ্রামবাংলার দূরাচার কে দূর করবে?

খ) আমরা বলি, বাংলায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ব্যর্থ। তৃণমূলের বড় নেতাদের কাছেও আসল খবর দ্রুত পৌঁছায় না। এঁরা এতটাই জনবিচ্ছিন্ন। তাই কসবার ‘ছাত্র নেতা’ কলেজে, থানায় দাদাগিরি চালায় কোনও দেবের স্নেহচ্ছায়ায়। লাগে রহো ম্যাংগোভাই বার অ্যাট ল’, এই অপরাধীরা ভবিষ্যতেই করবে আইনের চুলচেরা বিচার!

গ) কসবা-গড়িয়াহাটে তো তৃণমূলের বড় বড় কাউন্সিলার, মন্ত্রী। সেখানে প্রেস ক্লাবের বাড়ি বানাতে গেলে সিন্ডিকেটরাজের শিকার হতে হয়। কাউন্সিলার হাত তুলে দেন। টালিগঞ্জ থেকে মন্ত্রীর পদহীন, ক্ষমতাবান ভাই এসে পরিস্থিতি সামলান। এঁরা কেন সাইকোপ্যাথ ম্যাংগোভাইয়ের কীর্তিকলাপ জানতে পারেননি? নাকি জেনেও জানাননি?

গ) বিরোধীরাই বা এতদিন ঘুমোচ্ছিলেন কেন? ওই এলাকায় বিজেপি-সিপিএমেরও অনেক বুমপ্রেমী তরুণ তুর্কি আছেন, যাঁরা স্নো পাউডার মেখে টিভির সান্ধ্য কলতলার ঝগড়ায় মাতেন। তাঁরা এতদিনেও জানতে পারলেন না কেন? আমরা সাংবাদিকরাও একই প্রশ্নে কাঠগড়ায় বিদ্ধ হব। এই ম্যাংগো-কঙ্গোদের এত কুকীর্তি ফাঁস হয়নি কেন? বাংলার সব কলেজ ধরলে এমন ম্যাংগোভাই ক’জন মিলবে?

মুখ্যমন্ত্রী যদি কিছু ক্ষমতালোভী, ধান্দাবাজ মন্ত্রীকে বিশ্বাস করে রাজ্য চালান, তা হলে এসব অনিবার্য। মন্ত্রীরা নিজের সুবিধেমতো বোঝাবেন, আর মমতা তা মেনে নেবেন। এমন চললে আরজি কর, কসবা আরও হবে। রাজ্যজুড়ে কলেজে ছাত্র নির্বাচন বন্ধ কি স্রেফ এই কুলাঙ্গার-সমাজবিরোধীদের জায়গা করে দিতে?

সেদিন কলকাতার এক ট্যাক্সিচালক বলছিলেন, ‘প্রথমদিকে দিদি যেমন হাসপাতাল আর বিভিন্ন জায়গায় হঠাৎ যেতেন, এখন আর যান না। তাই এই দুর্দশা।’ তিনি পর্যন্ত যা বুঝছেন, মমতা নিজে সেটা বুঝছেন না। বরং যাঁদের ওপর ভরসা রাখছেন, তাঁরা স্বার্থ ছাড়া খবরই রাখেন না। মা-মাটি-মানুষের সঙ্গে যোগাযোগশূন্য। মুখের ওপর অপ্রিয় সত্য বলতে পারেন না।

কেউ মাস্তান ভাইয়ের স্বার্থ দেখছেন, কেউ নিজের ব্যবসা দেখছেন, কেউ ম্যাংগো-মার্ডারদের মতো সমাজবিরোধীকে আড়াল করছেন নিজস্ব স্বার্থে। ম্যাংগো-মনোজিৎকে কলেজে চাকরি দিলেন কোন নেতা? কোন নেতা মনোজিতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় আগের প্রিন্সিপালকে হেনস্তা করলেন? শাস্তি প্রাপ্য তাঁদেরও।
আরজি কর থেকে শিক্ষা নেননি মমতা বা অভিষেক, কেউই।

ছাত্রদের সঙ্গে মমতার কি আগের মতো যোগাযোগ রয়েছে আর? নইলে কসবায় তাঁরই পার্টির ছাত্র নেত্রী দলের নেতার হাতে ধর্ষিত হন কীভাবে। দু’দিন আগে দেখি খড়্গপুরে মমতার দলের নেত্রী প্রকাশ্যে মারছেন প্রবীণ মানুষকে। আর পানিহাটির এক মহিলা কাউন্সিলার রাস্তায় চুলোচুলি করছেন তরুণীর সঙ্গে। বিরোধীরাও তেমন অযোগ্য। শিলিগুড়ি কলেজে মার্ডারদের রুখতে শংকর ঘোষ, অশোক ভট্টাচার্যরা তো গৌতম দেবের মতোই ডাহা ফেল। ত্রয়ীর এক স্লোগান– লাগে রহো মার্ডারভাই!

সন্তোষ রানার আত্মজীবনীতে পড়েছি, পাইকপাড়ার ছাত্রাবাসে থাকার জন্য ইন্টারভিউ হত রাজভবনে মন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের বাড়িতে। ২৮ মেধাবী গরিব বাছা হত।

ইন্টারভিউতে প্রফুল্লবাবু নিজে উপস্থিত। মার্কশিট দেখে প্রশ্ন, ‘তোমার বাবা কী করেন?’ আইএসসিতে প্রথম কুড়িতে থাকা সন্তোষের উত্তর, ‘অল্প জমিতে চাষাবাস করে কোনওরকমে সংসার চলে।’

আর কোনও প্রশ্ন করেননি মন্ত্রী। ইন্টারভিউ শেষে এক নম্বরে নাম ছিল সন্তোষের। বলা হয়, হস্টেলে খাবার, জামাকাপড়, বিছানাপত্র, তেল-সাবান, বইপত্র সব পাবে, শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। হস্টেলে মিলত খদ্দরের ধুতি, গেরুয়া পাঞ্জাবি।

মৃত্যুর আগের বছর ১ জুলাই বিধান ছাত্রাবাসে এসেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। ছাত্রদের সঙ্গে দুপুরে খাবেন বলে। তখনই দিল্লি থেকে নেহরুর ফোন আসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে।

মানে কী দাঁড়াল? পরবর্তীকালের মুখ্যমন্ত্রী নিজে গরিবদের ছাত্রাবাসে থাকার জন্য ইন্টারভিউ নিতেন। সেরা ছাত্রটিকে খুঁজে নিতেন ঠিক। এবং মুখ্যমন্ত্রী জন্মদিনে যেতেন গরিব ছাত্রদের সঙ্গে লাঞ্চ করতে।

এসব গল্প মঙ্গল গ্রহের নয়। কিউবা বা কেরল বা চিনের নয়। এই বাংলারই গল্প ছিল।

Categories
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

জনগোষ্ঠীর সমর্থনের অঙ্কটা অত সরল নয়

গৌতম সরকার রাম শ্যামের হাত ছাড়লেন আর যদু এসে শ্যামের...

অবিশ্বাস আর ঘৃণার দরজা-জানলা ভাঙা যায় না

রূপায়ণ ভট্টাচার্য জাতীয় সড়কের হাত ছাড়িয়ে আসাম মোড় দিয়ে জলপাইগুড়ি...

চেতনা, দিশার সংকট

বাম নেতারা প্রায়ই অভিযোগ তোলেন, বাংলায় তৃণমূল ও বিজেপির...

ভরসা মা কালী, বঙ্গ বিজেপি বাঙালি হবে

  আশিস ঘোষ জয় মা কালী। এবার বঙ্গ বিজেপি আঁকড়ে...