পূর্ণেন্দু সরকার, জলপাইগুড়ি: বিতর্কিত জমির খতিয়ান নেই। আর তাই সরকারি ধান ক্রয়কেন্দ্রে নাম নথিভুক্ত করাতে পারেননি চাষিরা। এই পরিস্থিতিতে জমি থেকে ধান উঠতেই দক্ষিণ বেরুবাড়িতে (South Berubari) ঝাঁপিয়ে পড়েছে ফড়েরা। সরকারি সহায়কমূল্যের থেকে কম দামে তাদের কাছে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন নিরুপায় চাষিরা।
ডাকের কামাতের হরেন রায়, বুড়িরজোতের প্রদীপ রায় থেকে কাজলদিঘির কিরণ রায়ের মতো ধানচাষিরা তাঁদের জমির খতিয়ান না থাকায় নাম নথিভুক্ত করাতে পারেননি। দক্ষিণ বেরুবাড়ির প্রায় ৫০০০ কৃষক তাই প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে।
দক্ষিণ বেরুবাড়ির কাজলদিঘি, বড়শশী, চিলাহাটি, নাওতারি নবাবগঞ্জ ও নাওতারি দেবোত্তর গ্রামের অধিকাংশ মানুষের জমির কাগজ পূর্বপুরুষের নামে রয়েছে। নথিতে বাংলাদেশের বোদা থানার উল্লেখ থাকায় বর্তমানে সেই জমিতে বসবাসকারীদের নামে জমির নামজারি হয়নি। সীমান্ত নাগরিক সমিতির সভাপতি সারদাপ্রসাদ দাসের অভিযোগ, জমির খতিয়ান না থাকায় সরকারি ধান ক্রয়কেন্দ্রে ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
দক্ষিণ বেরুবাড়ির বিতর্কিত গ্রামগুলিতে প্রায় ৮০০০ মানুষের বাস। তাঁদের মধ্যে ৫০০০ বাসিন্দা কৃষক। তাঁদের প্রায় সকলেই এবার ধান চাষ করেছেন। এঁদের কারও জমির খতিয়ান নেই। ফলে সরকারি ধান ক্রয়কেন্দ্রে ২৩০০ টাকা কুইন্টাল দরে ধান বিক্রি করতে পারছেন না চাষিরা। এই সুযোগে এলাকায় এসে ফড়েরা তাঁদের কাছ থেকে ১৮৭৫ টাকা থেকে ১৯০০ টাকা কুইন্টাল দরে ধান কিনে নিচ্ছে। দক্ষিণ বেরুবাড়ি কৃষি সমবায় সমিতির ম্যানেজার মোজাম্মেল হক স্বীকার করে নিয়েছেন, ‘জমির খতিয়ান না থাকায় সরকারি মূল্যে ধান বিক্রি করতে আসছেন না স্থানীয় চাষিরা।’ নলজোয়াপাড়ার চাষি রণজিৎ দাসের আক্ষেপ, ‘আমাদের জমির খতিয়ান নেই। ধান বিক্রির জন্য স্লট বুকিং করতে পারিনি খতিয়ান না থাকার কারণে। ফড়েদের ১৮৭৫ টাকা দরে ১১.১৯ কুইন্টাল ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে পারলে ৪২৫ টাকা করে কুইন্টাল প্রতি বেশি পেতাম।’
ডাকের কামাতের আশুতোষ রায় বলেন, ‘জমি থেকে ধান তুলেছি। কিন্তু খতিয়ান না থাকায় রেজিস্ট্রেশন করাতে না পেরে এখন ফড়েদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করব।’ কাজলদিঘির কৃষক কিরণ রায় এবার সাত বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। তিনিও কম দামে বিক্রি করবেন বলে জানিয়েছেন।
দক্ষিণ বেরুবাড়ির পঞ্চায়েত প্রধান সুমিত্রা দেব অধিকারী মানছেন, সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। তিনি বলেন, ‘জমির খতিয়ান দেওয়ার বিষয়ে প্রশাসনকে অনেকবার বলেছি। নিজের নামে খতিয়ান না থাকায় সরকারি ধান ক্রয়কেন্দ্রে ধান বিক্রি করার সুবিধা পাচ্ছেন না এখানকার চাষিরা।’
রাজ্যে তৃণমূল সরকার ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও বেরুবাড়ির মানুষের প্রতিদিনের সমস্যা এতটুকু মেটেনি। স্থানীয় তৃণমূল নেতা নৃপতিভূষণ রায়ের প্রশ্ন, ‘স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন সরকারি মূল্যে ধান ক্রয়কেন্দ্রে এখানকার চাষিরা ধান বিক্রির সুবিধা পাবেন না? প্রশাসনকে সমস্যাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। জমির খতিয়ানের বিষয়টির দ্রুত সমাধান করা দরকার।’
‘কৃষকবন্ধু’র সুবিধা পাওয়ার জন্য জমির খতিয়ান দরকার হয়। জেলা খাদ্য নিয়ামক দাওয়া ওয়াঙ্গেল লামা জানান, যাঁদের নাম কৃষকবন্ধুতে আগে থেকে নথিভুক্ত আছে তাঁদেরও নতুন করে জমির খতিয়ান দেখাতে হবে। তবে যাঁদের খতিয়ান সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।’
জেলা শাসক শামা পারভিন মনে করেন, দক্ষিণ বেরুবাড়ির জমিজট সমস্যা খুবই স্পর্শকাতর এবং সেটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। তিনি বলেন, ‘জমির সমস্যা নিয়ে রাজ্যকে জানানো হয়েছে। ধান কেনার বিষয়ে খাদ্য দপ্তরকে বলেছি এলাকায় গিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার জন্য।’