Tuesday, June 18, 2024
Homeকলামহার মানা হার গলায় পরতে চান না নেতারা

হার মানা হার গলায় পরতে চান না নেতারা

গৌতম সরকার

‘সত্যেরে লও সহজে।’

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাটা আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের জিনে নেই। দিল্লির তখত-তাউস হোক বা সাবেক পাটলিপুত্র, দ্রাবিড়ভূম কিংবা এই বাংলা- এ ব্যাপারে ব্যতিক্রমহীন ক্ষমতার কারবারিরা। সদ্য কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গড়েছে সত্য। একইরকম সত্য যে, বিজেপিকে দেশের অধিকাংশ মানুষের ঘোর অপছন্দ। ১০ বছর কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলটাকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়নি মানুষ। বুঝিয়ে দিয়েছে, তোমার শাসনে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই।

নরেন্দ্র মোদি কিন্তু গণরায়ের নির্যাসটা মানলেন না। তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠল পরপর তিনবার জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বের রেকর্ডটা ছুঁয়ে ফেলা। যে কারণে তাড়াহুড়ো করে ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সদৃশ কিছু দলকে জুটিয়ে সরকার গড়ে ফেললেন। শোনা গেল সেই পরিচিত আস্ফালন, এনডিএ বরাবর শক্তিশালী ছিল, এখনও আছে। এই শরিকদের অনেকের মতাদর্শ, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান কিছুই নেই। উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে ক্ষমতা ভোগ এদের প্রধান লক্ষ্য।

এই দলগুলিকে কোলে তুলে নিল পৃথিবীর বৃহত্তম বলে ‘ঘোষিত’ দলটি। দলগুলির হাজার বায়নাক্কা, বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব। তাতে কী! জওহরলালের রেকর্ডটা তো ছোঁয়া গেল। যেন সেই আস্ফালন, ‘ম্যায় হুঁ না।’ তিনি থাকলে যেন জগতের আর কিছুকে পরোয়া নেই। মণিপুরে অশান্তি রোধে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ করলেন না। ‘আমি আছি তো, কিছু হবে না’ সুলভ ঔদ্ধত্যে গেলেন না পর্যন্ত মণিপুরে।

শুধু মেইতেই ও কুকি জনগোষ্ঠী যাতে আর কোনওদিন এক হয়ে না থাকতে পারে, তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিলেন। ব্রিটিশের সঙ্গে লড়াইয়ে উজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী মণিপুর কিন্তু শিক্ষা দিল। রাজ্যে বিজেপি সরকার থাকলেও লোকসভার দুটি আসনে কংগ্রেসকে জিতিয়ে দিল মেইতেই ও কুকি, উভয়ে।

বাংলাকে মুঠোয় পুরে ফেলার শোরগোল ছিল যথেষ্ট। মানুষ ২০১৯-এর চেয়ে কম আসন দিয়ে বুঝিয়ে দিল, তোমাদের ক্ষমতায় আনতে ভরসা পাচ্ছি না। এই আস্থাহীনতা শুধু মেরুকরণের প্রচার কিংবা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টির কারণে নয়। বরাদ্দ বন্ধ করে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনরা তৃণমূল সরকারকে ভাতে মারতে চেয়েছিল। প্রতিশোধপরায়ণতায় অন্ধ হয়ে তাতে বাংলাবাসীকেই ভাতে মারার জোগাড় হওয়ার সত্যটা থেকে মুখ ফিরিয়েছিল বিজেপি।

বরাদ্দ আটকে রাখার কথায় এ রাজ্যের পদ্ম নেতারা শুধু তাল মেলাননি, উসকেও দিয়েছেন। শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদাররা দিল্লিতে গিয়ে দরবার করেছেন কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আটকে রাখার জন্য। বিজেপির জন্য বাংলার রায়ের নির্যাসটা হল, আমাদের ভাতে মারতে চেয়েছিলে, এখন তুমিই ভাতে মরো। একধাক্কায় ৬টি আসন কেড়ে ১২-তে নামিয়ে দিয়েছে জনগণেশ। গণতন্ত্র আসলে কী, ঘাড়ে ধরে যোলোআনা বুঝিয়ে দিয়েছে।

এই শিক্ষা মানুষ অন্য দলকেও দিতে পারে। কিন্তু সেটা বোঝে কই অন্য দলগুলি! দু’দিন আগে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহের কথা শুনে সেটা মনে হল। ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে শহরাঞ্চলগুলিতে বিজেপি এগিয়ে থাকায় গোসা হয়েছে তাঁর। মাথাভাঙ্গায় এক সভায় হুমকি দিয়েছেন, ‘মাথাভাঙ্গা-১ ব্লকের জন্য ৪, মাথাভাঙ্গা-২ ব্লকের জন্য ১০ কোটি বরাদ্দ করেছি। মাথাভাঙ্গা, কোচবিহার ও আমার নিজের শহর দিনহাটার জন্য ১ টাকাও বরাদ্দ করিনি।’

বরাদ্দ বন্ধে একই প্রতিশোধপরায়ণতার ছক। মানুষের রায় সহজভাবে মেনে নেওয়ার বদলে তাচ্ছিল্য এবং একধরনের উন্নাসিকতা। উদয়ন বলেছেন, ‘গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ নিজেদের বেশি বুদ্ধিমান ভাবে।’ তিনি যে শুধু নিজের দলের সমর্থকদের নয়, গোটা রাজ্যবাসীর মন্ত্রী- এই সত্যটাকে ভুলে থাকেন। কোচবিহারের হেরো সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক এখন বলছেন, তাঁর হারে নাকি যত দোষ ইভিএমের। ইভিএমে নাকি তৃণমূল কারচুপি করেছে।

পাঁকে পড়লে সব নেতার এক রা। একই অভিযোগ এতদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করতেন বিজেপির বিরুদ্ধে। শুভেন্দু অধিকারী একই বাহানায় ব্যর্থতা লুকোতে মরিয়া এখন। তিনিও চার কেন্দ্রে ইভিএমে কারচুপির নালিশ জানাতে স্বভাবসিদ্ধভাবে আদালতে ছুটবেন জানিয়েছেন। রকমসকম দেখে রবীন্দ্রনাথের ‘বোঝাপড়া’ কবিতা মনে আসে। যেখানে সত্যকে সহজভাবে গ্রহণ না করার পরিণাম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন তিনি —–

‘তোমায় কতক ফাঁকি দেবে/ তুমিও কতক দেবে ফাঁকি,/ তোমার ভোগে কতক পড়বে/ পরের ভোগে থাকবে বাকি,/ মান্ধাতারই আমল থেকে/ চলে আসছে এমনি রকম-/ তোমারি কি এমন ভাগ্য/ বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম।’

রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ, ‘মনেরে আজ কহ যে,/ ভালো মন্দ যাহাই আসুক… সত্যেরে লও সহজে।/ তোমার মাপে হয় নি সবাই/ তুমিও হও নি সবার মাপে/ তুমি মর কারো ঠেলায়/ কেউ বা মরে তোমার চাপে-/ তবু ভেবে দেখতে গেলে/ এমনি কিসের টানাটানি?/ তেমন করে হাত বাড়ালে/ সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।’ এই সুখের কথা ভাবেন না কোনও নেতা।

বরং সত্যকে সহজভাবে না নেওয়ার যুক্তি দিতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন স্ববিরোধিতায়। ভোটের আগে রাজ্য বিজেপির মনোভাব ছিল, হুঁ-হুঁ বাবা, নির্বাচন কমিশন থাকবে, আধাসেনা আছে… তৃণমূলের বাপেরও জেতার সাধ্যি নেই। এখন ইভিএমে কারচুপির কথা বলে শুভেন্দু-নিশীথরা কিন্তু সেই কমিশন, আধাসেনাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। ভাবের ঘরে চুরি আর কী!

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Bagdah | উপনির্বাচনের টিকিট বিক্রি ৮০ লক্ষ টাকায়! প্রার্থী বদলের দাবিতে বিজেপিতে বিক্ষোভ বাগদায়...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ৮০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাগদা বিধানসভার উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন বিনয় বিশ্বাস! এমনই অভিযোগে দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন বাগদার স্থানীয়...

Sikkim | সিকিমে আটকে থাকা পর্যটকদের উদ্ধারে বিআরও-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছে প্রশাসন, সরানো হল...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সিকিমে (Sikkim) আটকে থাকা পর্যটকদের উদ্ধার অভিযানে এগিয়ে এসেছে বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন বা বিআরও (Border Roads Organisation)। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও...

Bomb Threat | পাটনা বিমানবন্দরে বোমা হামলার হুমকি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: পাটনার জয়প্রকাশ নারায়ণ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (Patna Airport) বোমা হামলার হুমকি। ইমেলের মাধ্যমে বোমা হামলার হুমকি (Bomb Threat) দেওয়া হয়েছে বলে...

Train Accident | সিগন্যাল ভাঙার অনুমতি দিয়েও কেন মালগাড়ির চালক-সহচালকের বিরুদ্ধে এফআইআর? প্রশ্নের মুখে...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: কাঞ্চনজঙ্ঘা বিপর্যয়ে (Train Accident) মালগাড়ির চালক ও সহকারি চালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে নিউ জলপাইগুড়ি জিআরপিতে। এক যাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে...

Train accident | বৃষ্টি পড়ায় বাতানুকূল কামরায় উঠেই প্রাণরক্ষা! দুর্ঘটনার কথা ভেবেই শিউরে উঠছেন...

0
গাজোল: অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল বলে অভিশপ্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের (Kanchanjungha Express) জেনারেল কামরায় উঠতে পারেননি। উঠে পড়েছিলেন এসি কামরায়। তার জন্যই হয়তো বরাতজোরে প্রাণে...

Most Popular