রূপায়ণ ভট্টাচার্য
এনজেপি স্টেশনের ফাঁকা পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এক নামগোত্রহীন ট্রেন দাঁড়িয়ে। আসলে মিলিটারি ট্রেন। সেনারা বলেন, রোলিং স্টক।
বুধবার রোদ্দুরমাখা সকাল। ইঞ্জিন লাগোয়া গোটা পাঁচেক এসি কম্পার্টমেন্ট সবুজ-মেরুন-সাদা রংয়ের। তারপর অনেকগুলো কোচ দরজা-জানলাবিহীন, অন্য রং। গায়ে লেখা, হাই ক্যাপাসিটি পার্সেল ভ্যান।
শেষ কম্পার্টমেন্টটা আবার সেই সবুজ-সাদা-মেরুন। তবে এসি নয়। যাত্রীরা সবাই মিলিটারি কর্মী।
কোচের বাইরে প্ল্যাটফর্মে তরুণ জওয়ান দাঁড়িয়ে। হাতে স্টেনগান। অচেনা লোক দেখে এক চোখে সন্দেহ, অন্য চোখে মৃদু হাসি।
তাঁকেই প্রশ্ন করি, ট্রেনটা যাবে কোথায়? এক লাইনের উত্তর, ‘আমরা যেখানে যাব।’ কোথা থেকে আসছেন? এক লাইনের জবাব : ‘অনেক দূর থেকে।’ তিনি জানেন, বেশি কথা বলতে নেই। বেশি বললেই যত বিতর্ক। শুধু নিজেদের লক্ষ্যে স্থির থাকলেই হল। আমাদের কাজ কথা বলা নয়।
আমাদের নেতারা জওয়ানদের নীতিতে বিশ্বাসী নন। অযথা বেশি বলতে গিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়েন নিজের জালে। সব গুলিয়ে একাকার। ভুল তথ্যের বন্যা ছেড়ে দিন, নামেই কত বিভ্রাট।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন সুনীতা উইলিয়ামসের প্রশংসা করতে গিয়ে সুনীতা চাওলা বলে ফেললেন। কল্পনা চাওলার সঙ্গে গুলিয়ে। শুভেন্দু অধিকারী আবার মমতাকে ‘মূর্খমন্ত্রী’ কটাক্ষ করতে গিয়ে প্রবল উত্তেজনায় সুনীতার পদবিই ভুল বলে দিলেন দু-দু’বার। পাশের সতীর্থ ভুল ধরিয়ে দিলে সুনীতা হয়ে গেলেন সনিয়া। উইলিয়ামস রাতারাতি উইলিয়াম।
ভুলের খেলায় এমন আত্মঘাতী গোল চলেই নেতাদের। ডোনাল্ড ট্রাম্পও স্বামী বিবেকানন্দের নাম বলেছিলেন, বিবেকমুন্ডন। মোদি একবার লালকেল্লায় স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে ভুল বলে গিয়েছেন পরের পর। রাহুল গান্ধি বিহার, কর্ণাটকে গিয়ে যাঁদের স্মরণে অনুষ্ঠান, তাঁদের নামই ভুল বলেন। অমিত শা যেমন অনেকবার নাম গুলিয়েছেন। হম কিসিসে কম নেহি।
মমতার এ ধরনের ভুল আকছার। সত্যজিৎ সরণিকে ধরণী বলা, সিধো-কানহোর সঙ্গে ডহরকেও লোক বানিয়ে ফেলা, নেহরুর ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ বইকে সটান ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ বলা, রাকেশ শর্মাকে রাকেশ রোশন বলা–কত কী শুনেছি! মোদিরও ‘মোহনলাল করমচাঁদ গান্ধি’ আমরা শুনেছি। শুভেন্দু একদা ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ এর মানেই পালটে দেন ‘যো হামারে সাথ হাম উনকা সাথ’ বলে।
এই তালিকা অনিঃশেষ। মুলায়ম সিং যাদব একবার সুভাষচন্দ্র বসুকে বললেন সুভাষচন্দ্র ভার্মা। নীতীশ কুমারের কীর্তি অজস্র? সেরা, জওহরলাল নেহরুকে জওহরলাল কুমার বানানো।
এই যে এত ভুলের মণিমুক্তোর মালা গাঁথা, নেতারা মোটেই অস্বস্তিতে পড়েন না। ভুল করলেও ভুল স্বীকারে নেই। ওইভাবেই যোগী আদিত্যনাথ কবীরকে বানিয়েছেন কবীর সিং। চন্দ্রবাবু নাইডু সিভি রমণকে বলেছেন সিভি রাও। স্ট্যালিনের কথায় চিদম্বরম পিল্লাই হয়ে গিয়েছেন চিদম্বরনাথ। বিজয়ন আবার নিজের পার্টির কৃষ্ণ পিল্লাইকে বলেছেন কৃষ্ণন।
বিদেশেও পাবেন এরকম ভুলভাল বলার প্রবণতা। ট্রাম্প, শি জিনপিং, পুতিন, এর্দোগান, নেতানিয়াহু, ম্যাক্রোঁ, ট্রুডো, জেলেনস্কি, শেহবাজ শরিফ, আলি খামেনেই–সবারই আছে এমন সম্পদ।
নেতারা অবশ্য জানেন, জনতা এতে অভ্যস্ত এখন। তারা বড়জোর ফেসবুকে দু’দিন খিল্লি করবে। সমমনোভাবাপন্ন লোকদের সঙ্গে কথোপকথনে মজা পাবে। তারপর চলে যাবে অন্য বিষয়ে। সাম্প্রতিক বাঙালির কূটকচালি বেশি রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে। ভিনরাজ্য বা বিদেশের খবরে মাথা ঘামায় না। ভাবনার ডালপালা বেশি ছড়ায় না নিরপেক্ষতা বা প্রতিবাদমনস্কতার অভাবে।
যা মনে করায় শিলিগুড়িকে।
এই যে ইদানীং প্রতি রাতে শিলিগুড়ির অনেকটা ঢেকে যাচ্ছে ধোঁয়ার আস্তরণে, প্রশাসনের মাথাব্যথা দেখছেন কোনও? প্রচুর প্রবীণ বা শিশু শ্বাসকষ্টে অস্থির, কুকুর-বিড়াল অসহায়, মেয়র গৌতম দেব ও তাঁর সঙ্গীরা কিছু স্থায়ী সমাধান ভেবেছেন? না। বিধায়ক শংকর ঘোষ রাজপথে লাগাতার প্রতিবাদে নেমেছেন? না। কোথায় সিপিএম-কংগ্রেস? ব্যাপারটা প্রসেনজিতের লিপে ‘জ্যোতি’ ছবিতে কিশোরকুমারের বিখ্যাত গানের মতো–ধোঁয়া, ধোঁয়া, ধোঁয়া।
বনের আগুন সামলানোয় এমনিতে বাংলা ভালো জায়গায়। উত্তরাখণ্ড, ওডিশা, ছত্তিশগড়, অন্ধ্র, তামিলনাডু, মহারাষ্ট্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ। বাংলা ভালো জায়গায় থাকলে শিলিগুড়ির দুর্দশা কেন? তিন বছর ধরে গোটা তিন ছেঁদো এক যুক্তি শুনে চলেছি। প্রশ্ন হল, এটা যখন নিয়মই, তবে চৈত্র-বৈশাখে শিলিগুড়ির প্রশাসকরা আগাম সতর্কতা নেন না কেন? দিন দুই আগে শুনলাম, ২০২৫-২০২৬ আর্থিক বছরে ৬৮৫ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা খরচের এবং ১২ কোটি ৪০ লক্ষ টাকার ঘাটতি বাজেট পেশ করেন মেয়র গৌতম দেব। গতবার মার্টিন লুথার কিংয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করে বাজেট বক্তৃতা ছিল গৌতমের। ‘Darkness cannot drive out darkness; only light can do that. Hate cannot drive out hate; only love can do that.’
আলো-আঁধার, ঘৃণা-ভালোবাসার ধাঁধার মধ্যে ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়া। ২০২৪-’২৫-এ ৬১৮ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকার বাজেট বরাদ্দ পেশ হয়। ২০২৩-’২৪ এ বাজেট বরাদ্দ ছিল ৫৯১ কোটি ৭৭ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৭-২০১৮ বছরে প্রস্তাবিত খরচ দেখছি ২৩৫ কোটি ৬৯ লক্ষ, ঘাটতি ২.২২ কোটি টাকার। মানে সাত বছরে শহরের বরাদ্দ টাকা প্রায় তিনগুণ। উত্তরবঙ্গ উপেক্ষিত, তা তো এখানে বলা যাবে না! শিলিগুড়ির রাজপথে ঘোরার ফাঁকে ভাবি, শহরে বাজেট বৃদ্ধির প্রতিফলন কোথায়? এখনও খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হয়, কী সূদূরপ্রসারী উন্নতি হল শিলিগুড়ির। যা নিয়ে কুড়ি বছর পরেও সশ্রদ্ধ বলাবলি করবে জনতা। তবু নেতাদের কথা কমে না। সেনাদের ট্রেন নিঃশব্দে সবার অজান্তেই লক্ষ্যের স্টেশনে পৌঁছে যায়। নেতাদের উচ্চকিত ট্রেন মাঝে মাঝেই মুখ থুবড়ে পড়ে, স্টেশন অধরা থেকে যায়।