গ্রন্থন সেনগুপ্ত
দেখতে দেখতে আরও একটা বছর কেটে গিয়েছে। সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে মানুষ আবার ছেঁড়া মেঘের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে ওখানে ফুটেছে কাশফুল। বাতাসে একটা পুজো পুজো ভাব। যাদের টিকিট এখনও কনফার্ম হয়নি, তারা তৎকালের আশায় বসে। যাদের ছুটি এখনও মঞ্জুর হয়নি, তারা পেড লিভের ভরসায় দিন গুনছে। পাড়ায় পাড়ায় মণ্ডপের কাজ প্রায় শেষ। কিছু পাড়ায় লাগানো হচ্ছে লাইট।
মোড়ের চায়ের দোকানের পাশে বিশাল এক মণ্ডপ। আজ আড্ডা জমেছে বেশ। পাড়ার প্রবীণদের বক্তব্য যে, থিম পুজোর থেকে সাবেকি একচালার পুজো ছিল ঢের ভালো। ওদের ছোটবেলায় পুজোতে পুরো পাড়াটা এক হয়ে যেত। খুঁটিপুজো থেকে শুরু হয়ে যেত তোড়জোড়। কেউ এবার চাল দেবে, কেউ বা দেবে ঠাকুর।
একলহমায় দেখলে মনে হত যেন পুরো পাড়াটা আসলে একটাই বিরাট বাড়ি। যার চাতালে পুজো। আর সেই চাতালে এসে জড়ো হয়েছে পাড়ার প্রত্যেকে। পুজো শেষ হয়ে গেলেও রেশ সেখানে থাকত আরও বেশ কয়েকদিন। বিজয়ার পর সবার বাড়ি যাওয়া ছিল আরেকটা বড় ব্যাপার। যে বাড়ি যত উদার, মানে যে বাড়িতে গেলে প্লেট আর পেট দুটোই ভরে, সেখানে প্রণাম করার জন্য লম্বা লাইন লেগে যেত।
চায়ের দোকানে বসে থাকা মাঝবয়সি লোকরা এতক্ষণ সব কথা শুনছিল মন দিয়ে। কোনও কথা বলেনি। কিন্তু এবার ওরা বলতে আরম্ভ করল। ওদের কিন্তু দাবি অনেক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওরা বড় হয়েছে। সাবেকি একচালার বদলে ওরা নিয়ে এসেছে থিম পুজোর কনসেপ্ট। পুরো পাড়াটা ভাগ হয়ে গিয়েছে দুটো ক্লাবে। যারা সারাবছর ধরে ফুটবল খেলা কিংবা বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, সবেতেই একে অন্যকে ছাপিয়ে যেতে চায়। এহেন দুটো ক্লাব পুজোর সময় হাত গুটিয়ে বসে থাকবেই বা কেন?
কে কত বড় ঠাকুর বানাল, কার ক’টা প্রাইজ এল, কার মণ্ডপে বেশি ভিড় হল- সেই নিয়ে যেন হুলুস্থুল কাণ্ড পড়ে যেত। পাড়াটা ক্লাবে ভাগ হয়ে গেলেও ইমোশনের জোয়ারে কোনও ভাগ হত না অবশ্য। সেটা প্রত্যেক বছরের মতো একইভাবে পাড়ার প্রতিটা অলিগলি দিয়ে বইতে থাকত। আসলে পুজো মানেই নস্টালজিয়া, পুজো মানেই রোমন্থন। পুজো মানেই প্রেম, পুজো মানেই ঘরে ফেরা। পুজো আসলে শ্বাসবায়ু।
বছরের প্রতিটা দিন ঘামে ভিজে, বাসে-ট্রামে চড়ে এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত করে বেড়ানো বাঙালির মনের টান এই উৎসব। যেখানে স্মৃতি তৈরি হয়, আবেগে ভেসে যায় বছরের সব ক্লান্তি। ছোটদের ক্যাপ বন্দুক আর ঢাকিদের ঢাকের আওয়াজ ছাপিয়ে যায় নাগরিক যান্ত্রিকতাকে।
চায়ের দোকানে বসে থাকা সবথেকে নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একটি কথা বলেনি এখনও। শুধু একবার চা খেয়ে উঠে যাওয়ার সময় বলল, প্রতিবার যে উৎসাহটা থাকে, সেটা এবারে মিসিং। আসলে মাতৃশক্তির আরাধনাকালে শহরের মেয়ের এরকম নৃশংসভাবে দুনিয়া থেকে চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া কঠিন। মায়ের আগমনে শহরের মেয়ের বিসর্জন কেউ চায়?
প্রত্যেকবার, প্রতিটা প্রজন্মেই পুজোর কিছু নস্টালজিয়া তৈরি হয়। এবারে যে ঘটনাটি ঘটল, সেটা আর যাই হোক নস্টালজিয়া নয়। সেটা কলঙ্ক। বিচারের দাবিতে এবার আমরা অন্তত এটা নিশ্চিত করতেই পারি যে, এরূপ কলঙ্ক যেন আর কখনও কোনও পুজোর নস্টালজিয়া নিয়ে লেখা প্রবন্ধে ফিরে না আসে। আর যাই হোক, এই কলঙ্ক ঢাকা নস্টালজিয়া আমাদের পুজোর স্মৃতি নয়।