মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

নগরজীবনে বিষণ্ণতার প্রান্তরে একাকিত্ব

শেষ আপডেট:

 

  • রুদ্র সান্যাল

শহরজীবন যত আধুনিক হচ্ছে, মানুষের জীবনযাত্রার মান তত উন্নত হচ্ছে, কিন্তু একই সঙ্গে বাড়ছে একাকিত্বের সমস্যা। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, নগরজীবনে বসবাসরত ব্যক্তিদের মধ্যে বিষণ্নতা ও মানসিক চাপে ভোগার হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে মানুষ আজ বাস্তব সম্পর্কগুলোকে অবহেলা করছে, ফলে তারা ভার্চুয়াল জগতে বন্ধুত্বের আশ্রয় নিচ্ছে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর।

ভারতের বড় শহরগুলোতে চাকরি ও শিক্ষার কারণে একা বসবাসের প্রবণতা বেড়েছে। এক সার্ভে অনুযায়ী, কলকাতায় বসবাসরত প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের কর্মব্যস্ত জীবনের কারণে পরিবার বা পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করার সুযোগ পায় না। প্রতিযোগিতার এই শহরে মানুষ দিনশেষে ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ফিরলেও, তাদের মনের একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য তেমন কেউ থাকে না। ফলে তারা সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

বর্তমানে কৃত্রিম সম্পর্কের বিস্তারও একাকিত্বের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম সহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে, কিন্তু বাস্তব জীবনে সম্পর্কগুলো দিন-দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের ৭০ শতাংশই নির্দিষ্ট সময় পর নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কারণ এসব সম্পর্ক মূলত তাৎক্ষণিক বিনোদন বা প্রয়োজনের ওপর নির্ভরশীল। বাস্তব জীবনে কাউকে সময় দেওয়া বা মানসিকভাবে সমর্থন করা যেখানে কঠিন, সেখানে ভার্চুয়াল জগতে কয়েক সেকেন্ডেই ‘লাইক’ বা ‘কমেন্ট’ দিয়ে বন্ধুত্ব বজায় রাখা সম্ভব।

একাকিত্ব মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিষণ্নতা হবে বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা, যার বড় একটি অংশ শহুরে একাকিত্বের কারণেই হবে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। একটি মানসিক স্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৩৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী একাকিত্বজনিত বিষণ্নতায় ভুগছেন, যা তাঁদের কর্মক্ষমতা ও ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে একাকিত্বের হার আরও বেশি। শহরজীবনের ব্যস্ততায় অনেক পরিবার তাদের বয়স্ক সদস্যদের প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারে না, ফলে তাঁরা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। পরিবার ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং ভার্চুয়াল সম্পর্কের চেয়ে বাস্তব যোগাযোগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। গবেষকরা মনে করেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, নিয়মিত পারিবারিক সময় কাটানো, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে একাকিত্ব অনেকটাই কমানো সম্ভব। এছাড়া, কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝে সময় বের করে প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া, বই পড়া ও ব্যায়ামে মনোযোগী হওয়াও একাকিত্ব দূর করতে সহায়ক হতে পারে।

শহরজীবনের আধুনিকতা ও প্রযুক্তির অগ্রগতি মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু আন্তরিকতা কমিয়ে দিয়েছে। যদি আমরা কৃত্রিম সম্পর্কের মোহ থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকে গুরুত্ব দিই, তবে নগরজীবনের একাকিত্ব অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। বাস্তব সম্পর্ক ও মানবিক সংযোগই পারে আমাদের জীবনকে সত্যিকারের অর্থবহ করে তুলতে।

(লেখক বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের শিক্ষক)

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পনেরোর নামতায় বুধরামদের দুঃস্বপ্ন

  সুকান্ত নাহা বুনোট ন্যাড়া হয়ে যাওয়া জমিটা এখন প্রায়...

মিল-অমিলের যুদ্ধে যাদবপুর-জেএনইউ

  জয়ন্ত ঘোষাল জেএনইউ এবং যাদবপুর যেন দু’ভাই। যদিও দুজনের...

পাহাড়ে হোমস্টে বিপ্লবে লাল সংকেত

প্রশান্ত মল্লিক কুড়ি-বাইশ বছর আগে, যখন হোমস্টে পর্যটনের ধারণা সবেমাত্র...

যোগেন মণ্ডল : এক ইতিহাসের নায়ক

অশোক ভট্টাচার্য ১৮৭২ সালের জনগণনা থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলার...